ধর্মের কল বাতাস নড়ায় বলিয়া যদি ধার্মিকগণ বিশ্বাস করেন, তবে বিজ্ঞানে আস্থাবান মানুষেরা দাবি করিতে পারেন যে, পাপীর বিচার শেষ করিয়া থাকে বিজ্ঞান। অন্যায়কারীরা বিচারের সম্মুখীন হইতে চাহেন না, ছলচাতুরীপূর্বক তদন্ত এড়াইয়া চলিতে চাহেন। বিচার যেহেতু অকাট্য প্রমাণসাপেক্ষ—আর প্রমাণ এক শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া— সেই হেতু কাঠগড়ায় দাঁড়াইলেও দোষী সব সময় সাজা পায় না। প্রকৃত দোষীর সাজার বদলে দণ্ড পায় নির্দোষ ব্যক্তি। এমতাবস্থার নিরসনে বিজ্ঞান বহুকাল পূর্বেই ময়দানে অবতীর্ণ। কোনও মৃত্যু স্বাভাবিক কারণে না বিষপ্রয়োগে, কোনও কঙ্কাল নর কিংবা নারীর, ইত্যাকার প্রশ্নের সমাধান করে বিজ্ঞান। ফরেনসিক সায়েন্স নামক তদন্তপ্রক্রিয়া এখন অনেক উন্নত। সেই উন্নতির এক মূল্যবান সোপান ডিএনএ-তদন্ত। মানবদেহের কোষে উপস্থিত রাসায়নিক উপাদান যে অপরাধ তদন্তেও সাহায্য করিতে পারে, সেই জ্ঞান আধুনিক গবেষণার এক আশীর্বাদ। আর সেই আশীর্বাদের সাম্প্রতিক নমুনা বসনিয়া-র মুসলমান-বিদ্বেষী নেতা রাদোভান কারাৎঝিক-এর বিচার এবং দণ্ডপ্রাপ্তি। একদা মহা প্রতিপত্তিশালী ওই রাষ্ট্রনায়ক আপাতত কারান্তরালে। চল্লিশ বৎসর কারাবাসের সাজা মিলিয়াছে তাঁহার।
নৃশংস আচরণের জন্য কারাৎঝিক ‘স্রেব্রেনিকা-র কসাই’ নামে কুখ্যাত। নামকরণ অমূলক নহে। বসনিয়া-য় যে যুদ্ধ চলিয়াছিল ১৯৯২ হইতে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত, সেই স্বল্প সময়ে কারাৎঝিক-এর ব্যবস্থাপনায় যে ৮০০০ মুসলমান নিধন হইয়াছিল, তন্মধ্যে বহু শিশুও ছিল। ভয়ার্ত মুসলমানেরা স্রেব্রেনিকা শহরে আশ্রয় লইয়াছিল। তাঁহাদের নিরাপত্তা রক্ষায় রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিরক্ষক বাহিনীও মজুত ছিল। কিন্তু কারাৎঝিক-এর নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষকদের পর্যুদস্ত করিয়া মাত্র চারি দিনে ৮০০০ মুসলমানকে হত্যা করে। স্বজনবিয়োগে ব্যথাতুর হাজার হাজার পরিবার ঘাতকের বিচার কামনা করিলেও ফল মিলে না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কারাৎঝিক পলাতক, এমনকী ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া আত্মগোপনও করেন। অবশেষে গ্রেফতার হইবার পর, আন্তর্জাতিক আদালতে তাঁহার বিচার শুরু হয় ২০১০ সালে। এত দিনে তাঁহার অপরাধ প্রমাণিত হইবার পর কারাৎঝিক সাজা পাইলেন।
অপরাধ প্রমাণে বিচারপর্বে মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ডিএনএ-তদন্ত। হাজার হাজার মুসলমান পরিবার অভিযোগ করেন, তাঁহাদের সদস্যেরা নিখোঁজ। ওইরূপ সদস্যদের সন্ধানে নামে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন মিসিং পার্সন্স। নানা গোপন স্থানে গণকবরে প্রাপ্ত হাজার হাজার কঙ্কাল যে অভিযোগকারী পরিবারের নিখোঁজ সদস্যদেরই, তাহা প্রমাণ হইবে কী রূপে? ওই কার্যে প্রযুক্ত হয় ডিএনএ-তদন্ত। অভিযোগকারী পরিবারের জীবিত সদস্যদের দেহকোষের ডিএনএ এবং কঙ্কালের হাড়ের কোষের ডিএনএ মিলাইয়া দেখিয়া তদন্তকারীরা নিশ্চিত হন নিখোঁজ ব্যক্তিরা অভিযোগকারী পরিবারেরই সদস্য। অন্য দিকে, গণকবর প্রমাণ করে নির্বিচারে এককালীন হত্যাকাণ্ড। আন্তর্জাতিক আদালতে অপরাধটি প্রমাণিত হইলেও কারাৎঝিক দায় অস্বীকার করেন। কিন্তু গণকবরগুলি কোন সময়কার, এবং তৎকালে কোন নেতার অঙ্গুলিহেলনে সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হইত, তাহা জানা থাকায়, কারাৎঝিক-এর যুক্তি চূর্ণ। যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধানে ডিএনএ এক নূতন ভূমিকায় অবতীর্ণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy