কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আসনে সুরঞ্জন দাস যখন সমাসীন হন, তখন ক্যালেন্ডারে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ, মহাকরণে বামফ্রন্ট সরকার। ক্যালেন্ডার নশ্বর, বামফ্রন্ট অতীত, মহাকরণও নবান্ন-প্রাপ্ত। সুরঞ্জনবাবু আজও অবিচল। নবান্নের অধিষ্ঠাত্রী দিকে দিকে বিস্তর লাল মুছিয়া নীল করিয়াছেন, পুরাতনদের বিদায় জানাইয়া নূতনদের আনিয়াছেন, কিন্তু যে বিরল কয়েকটি উচ্চাসনে পূর্ববর্তীরাই পরবর্তী, দ্বারভাঙা ভবনের বড় চেয়ারটি তাহাদের অন্যতম। এই চেয়ারটিতে তাঁহাকে বসানো অন্যায় বা অযৌক্তিক হইয়াছিল, এমন কথা সুরঞ্জনবাবুর শত্রুরাও বলিবেন না। তিনি ইতিহাসের কৃতী ছাত্র, গবেষক ও শিক্ষক, পশ্চিমবঙ্গের বিদ্বৎসমাজের তিনি স্বীকৃত ও সম্মানিত সদস্য। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদের জন্য যে ধরনের সম্ভাব্য শিক্ষাবিদের কথা আজ ভাবা চলে, সেই মাপকাঠিতে তিনি যথেষ্ট উপযুক্ত। তদুপরি, তিনি বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন মতের মানুষ ও প্রতিষ্ঠান লইয়া কাজ করিতে পারেন, বিভিন্ন পরিস্থিতির সহিত নিজেকে মানাইয়া লইতে পারেন। দুর্জনে তাঁহার এই নমনীয়তাকে অন্য নাম দিয়া থাকে। তাহা সুনাম নহে।
দুর্জনের বাক্যে কিছু যায় আসে না। সমস্যা হইল, সুরঞ্জন দাস মহাশয় নিজেই নিজের সম্মানে আঘাত করিতেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনামধারী গুন্ডাদের কুৎসিত তাণ্ডবের পরে তিনি (অ)ম্লানবদনে জানাইয়াছেন, ‘আগে উত্তেজনা ছিল, পরে তা ঠিক হয়ে যায়, এর থেকে বেশি কিছু বলব না।’ বুধবারের ঘটনাকে ‘উত্তেজনা’ বলিলে তালকে তিল করা হয়, সে কথা তিনি নিশ্চয়ই জানেন। বস্তুত, সব যে ‘ঠিক’ হইয়া গিয়াছে, সেই সুসংবাদটি জানাইতেই যেন তাঁহার বিশেষ আগ্রহ, আর কিছু বলিবেন না তাহা জানাইয়া দিতেই তিনি তৎপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের মানমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত, অথচ উপাচার্য শান্তিজল ছিটাইয়া নিজেকে সরাইয়া লইতে ব্যস্ত! এই বিসদৃশ দৃশ্যটি দ্বিগুণ লজ্জাকর হইয়াছে এই কারণে যে, শিক্ষামন্ত্রী গুন্ডাদের নিন্দা না করিয়া শিক্ষকদের ‘ছাত্রসুলভ’ আচরণের নিন্দায় মুখর হইয়া পড়েন এবং, যেন সেই নিন্দার প্রেরণাতেই, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হয়। দলতন্ত্র এবং গুন্ডা-রাজের ভয়ঙ্কর সমন্বয়ের বিরুদ্ধে তীব্র ও বলিষ্ঠ প্রতিবাদ দূরে থাকুক, পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা তাহাকেই সরাসরি প্রশ্রয় দিতেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর মত ও পথ অনুসরণ করিয়া হয়তো বুধবারের উপদ্রবকেও তাঁহারা ‘ছোট ছোট দামাল ছেলেদের’ যৌবনজলতরঙ্গ বলিয়াই বরণ করিবেন।
তাহা করিতেই পারেন, যাঁহাদের যেমন স্ব-ভাব। কিংবা, স্ব-ধর্ম। কিন্তু সেই কদর্য অন্যায়কে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ‘সব ঠিক হইয়া গিয়াছে’ বলিয়া মানিয়া লইবেন? ইহাতে তো দুর্জনেই বলিবার সুযোগ পায় যে, শাসকদের অসন্তোষ উৎপাদন করিতে চাহেন না বলিয়াই তাঁহার এমন আশ্চর্য আচরণ! এমন কটুকথা শুনিতেও তাঁহার ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে না কি? যদি লাগে, তবে কি তাঁহার ভাবিয়া দেখা উচিত নহে, কেন এখনও এই পদটিতে তিনি নিজেকে বসাইয়া রাখিয়াছেন? কেনই বা তিনি কলিকাতা ছাড়িয়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হইতে চাহেন? এই পদান্তর তাঁহার পক্ষে ‘অবনমন’ কি না, সেই কূটপ্রশ্ন না-হয় আপাতত মুলতুবি রাখা গেল, কিন্তু সাত বছর উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের পরে শিক্ষকতা ও গবেষণার নিজস্ব ভুবনে প্রত্যাবর্তনই কি শ্রেয় নহে? তাহাতে আর কিছু না হোক, অবশিষ্ট সম্মানটুকু বাঁচে। এবং, কে বলিতে পারে, হয়তো বা পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁহার সর্বাধিনায়িকা ঈষৎ লজ্জায় ভাবিতে পারেন— সত্যই বাড়াবাড়ি করিয়া ফেলিয়াছি, সুরঞ্জনবাবুও হজম করিতে পারিলেন না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy