Advertisement
০২ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

আসুন, ভদ্র ভাষার শোকসভা ডাকি

ভাষা ব্যবহারে মধ্যবিত্ত জীবনে একটা আগল ছিল। ভাবনার জগতে যা-ই থাক, ব্যবহারিক সৌজন্য বজায় থাকত। সেটা হাওয়া হয়ে গিয়েছে। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়।গত ক’দিন ধরে সর্বত্র তাপস পালকে নিয়ে যত আলোচনা কানে এল, গুরুদক্ষিণা বা অনুরাগের ছোঁয়ার পরেও এতটা শুনিনি। এত মানুষ বিষয়টা নিয়ে ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, ক্রুদ্ধ সেটা নিঃসন্দেহে ভাল কথা।

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

গত ক’দিন ধরে সর্বত্র তাপস পালকে নিয়ে যত আলোচনা কানে এল, গুরুদক্ষিণা বা অনুরাগের ছোঁয়ার পরেও এতটা শুনিনি। এত মানুষ বিষয়টা নিয়ে ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, ক্রুদ্ধ সেটা নিঃসন্দেহে ভাল কথা। কিন্তু অনেককেই যে ভাষায় তাপসকে গালমন্দ করতে শুনলাম, তার ভিডিয়ো ক্লিপিং কিন্তু তাপসের টিআরপি-ও কমিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

গুলিয়ে যেতে লাগল। তাপস একা তা হলে অন্যায়টা কী করেছেন?

হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, তাপস জনপ্রতিনিধি। তাঁর দায়দায়িত্ব অনেক বেশি, অনেক আলাদা। বন্ধুমহলে একটা কথা বলা আর জনসভায় নেতা হয়ে বক্তৃতা করা এক জিনিস নয়। মেনে নিলাম। রাজনৈতিক হিংসায় উস্কানিমূলক মন্তব্য করার দায়ে আইন মেনে তাপসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই উচিত ছিল।

কিন্তু সেই সঙ্গে এই ভাবনাটাও এড়াতে পারি না জনপ্রতিনিধি তো জনেরই প্রতিনিধি। জন যেমন তার প্রতিনিধিও তেমন। তাপস পাল যখন গলার শির ফুলিয়ে তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছিলেন, অজস্র মানুষ ওখানে দাঁড়িয়ে সোত্‌সাহে হাততালি দিচ্ছিলেন। কেউ কিন্তু বলেননি, আমরা এই সব জঘন্য কথা শুনতে চাই না। তাপসকেও বলেননি। অনুব্রত-মনিরুল-আনিসুর-অনিল বসুকেও বলেননি। বলেন না। শুধু ভয়ে বলতে পারেন না, তাই নয়। মানুষ এ সব উপভোগ করেন, এই সত্যকেও অস্বীকার করা চলে না। বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যম, মোবাইল ক্যামেরা আর ইউটিউবের যুগে এগুলো এখন সবাই দেখতে পাচ্ছেন, এটাই যা নতুন।

তাপসের হুমকির চেয়েও অনেক বড় ভয়ের কথা হল, হিংস্রতার এই পরিব্যাপ্তি। হিংস্রতা যেখানে সবচেয়ে বড় বিনোদন। ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে অগ্রসর ভিলেন আর স্খলিত বসনে এক পা করে পিছনো নায়িকাকে দেখে ধর্ষকাম উপভোগ করতেই জনতা অভ্যস্ত। মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে নায়ক তো ছবির পর্দায় এ কথা প্রকাশ্যেই বলেন। সেখানেও হাততালিই পড়ে। আর নায়কের যদি পুলিশের উর্দি থাকে, তা হলে আরও সোনায় সোহাগা। তাঁর জন্য সব রকম হিংস্রতার লাইসেন্স সরকারি ভাবেই থাকে, এ রকমই ধরে নেওয়া হয় সেখানে। মানবাধিকার বলে কোনও বস্তু আছে, সেটা আর যাই হোক জনপ্রিয় সিনেমা দেখে কোনও দিন বোঝা যায়নি। তাপসের জনসভার মেজাজটা তার চেয়ে খুব আলাদা কিছু ছিল কি?

মুখের ভাষা মনের ভাবনারই প্রকাশ। ভাবনার হিংস্রতা যদি না কমে, তা হলে বাইরে থেকে ভাষা বদলাবে কী করে? আর জীবনযাপনটাই যদি একটা হিংস্রতার পরিমণ্ডলে ঘুরপাক খেতে থাকে, তা হলে ভাবনার গড়নই বা বদলাবে কী করে?

দীর্ঘ দিন অবধি ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত জীবনে অন্তত একটা আগল ছিল। সব কথা বলতে নেই, সবার সামনে বলতে নেই, সব জায়গায় বলতে নেই, বললেও লিখতে নেই এই রকম কতকগুলো গণ্ডি ছিল। ফলে ভাবনার জগতে যা-ই থেকে থাক না কেন, সেটা সব সময় প্রকাশ্যে এসে পড়ত না। ব্যবহারিক সৌজন্য বজায় থাকত। সেটা বেশ কিছুকাল যাবত্‌ একেবারে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। উন্মুক্ত অর্থনীতি দরজার সব খিলই ভেঙে দিয়েছে। ব্যক্তি-পরিসর আর জন-পরিসরের মধ্যে সীমারেখা ঘুচে গিয়েছে। যে সব শব্দ ছাপার অযোগ্য বলে গণ্য হত, সে সব আজ মুড়িমুড়কির মতো সোশ্যাল মিডিয়ার দেয়ালে ভেসে বেড়াচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইটে তাপসের ভিডিয়োর নীচে তাঁর পরিবারকে কদর্যতর হুমকি দিয়ে মন্তব্য পোস্ট করা হয়েছে, কিছু দিন আগেও যা অকল্পনীয় ছিল।

গত কয়েক বছরের মধ্যে সিনেমা-থিয়েটার-সাহিত্যে গালাগালি ব্যবহারের প্রবণতা যে ভাবে বেড়েছে, সেটাও তো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এখানে শিল্প জীবন থেকে টুকছে নাকি জীবন শিল্প থেকে, সে প্রশ্নটা অবান্তর। কিন্তু যেটা নজরে না এসে পারে না, সেটা হল কুকথার বিনোদনমূল্য হঠাত্‌ বেড়ে ওঠাটা। বাস্তবতার প্রতিফলন, চরিত্র নির্মাণের লজিক, নিম্নবর্গের অন্তর্ঘাত সব কিছু অতিক্রম করে বা বলা ভাল এইগুলোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ঢালাও খিস্তির স্রোত এবং দর্শকের সোল্লাস লুটোপুটি। এবং এখানে সত্যিই কোনও আমরা-ওরা নেই। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় এক পরিবর্তনপন্থী বিশিষ্টকে প্রকাশ্য জনসভায় একই রকম গালির ঝুলি খুলে বক্তৃতা করতে দেখা যেত। প্রচুর হাততালিও পড়ত।

ওই যে বললাম, বিনোদনমূল্য! কুকথা যদি কোনও প্রোডাক্ট হয়, তার ক্রেতা আমরা সকলেই। আর যার কাটতি আছে, তাকে বাজার থেকে হটাবে কে? সবার উপরে বাজার সত্য এ কথা যদি অর্থনীতির গুজরাত মডেলে খাটতে পারে, রাজনীতির নাকাশিপাড়াতেই বা খাটবে না কেন? তাপস-অনুব্রতরা যা করে বেড়াচ্ছেন, তা অবশ্যই প্রশাসনিক পদক্ষেপ দাবি করছিল। কিন্তু শাসকের হাত যখন যার মাথায় থাকে, সে অন্যায় করে শাস্তি পায়, এমন অভিজ্ঞতা আমাদের কোনও কালেই নেই। কারণ রাজনীতির বাজার সে অঙ্কে চলে না। তার চেয়ে বরং আমরা একটি শোকসভা ডাকি আসুন। অকথ্য, অশ্রাব্য আর মুদ্রণ-অযোগ্য নিহত এই তিনটি শব্দের স্মরণে।

এরা এখন ভাষা-শহিদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial jagori bandopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE