Advertisement
১০ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ইতিহাস সম্ভবত ইউপিএ-র প্রতি সদয়তর হবে

এই সুতীব্র আর্থিক বৃদ্ধি-বন্দনার বাজারে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারটিকে ‘দুঃসাহসী’ না বলে কোনও উপায় নেই। ‘সর্বজনীন উন্নয়ন’-এর বহুনিন্দিত পথ থেকে সরে না আসার দুঃসাহস। ইস্তেহারে গোলমাল প্রচুর, বাস্তবের সঙ্গে প্রতিশ্রুতির ব্যবধানও অনেক। কিন্তু, সেই সব ছাড়িয়ে যা চোখে পড়বেই, তা হল অধিকারভিত্তিক উন্নয়নের নীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি।

সহায়। কর্মসংস্থান যোজনার একটি অনুষ্ঠানে সনিয়া গাঁধী, মনমোহন সিংহ এবং জয়রাম রমেশ। দিল্লি, ২০১৩। ছবি: প্রেম সিংহ।

সহায়। কর্মসংস্থান যোজনার একটি অনুষ্ঠানে সনিয়া গাঁধী, মনমোহন সিংহ এবং জয়রাম রমেশ। দিল্লি, ২০১৩। ছবি: প্রেম সিংহ।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৩৮
Share: Save:

এই সুতীব্র আর্থিক বৃদ্ধি-বন্দনার বাজারে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারটিকে ‘দুঃসাহসী’ না বলে কোনও উপায় নেই। ‘সর্বজনীন উন্নয়ন’-এর বহুনিন্দিত পথ থেকে সরে না আসার দুঃসাহস। ইস্তেহারে গোলমাল প্রচুর, বাস্তবের সঙ্গে প্রতিশ্রুতির ব্যবধানও অনেক। কিন্তু, সেই সব ছাড়িয়ে যা চোখে পড়বেই, তা হল অধিকারভিত্তিক উন্নয়নের নীতিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি। ২০০৪ সালে কংগ্রেস যখন প্রথম সর্বজনীন উন্নয়নের কথা বলেছিল, সম্ভবত কেউ তেমন গুরুত্ব দেননিও। কিন্তু, পরের দশ বছরের অভিজ্ঞতা স্পষ্টতই ভিন্ন। কর্মসংস্থানের অধিকার থেকে শিক্ষা, খাদ্যের অধিকার, এবং অবশ্যই তথ্যের অধিকার— ইউপিএ সম্পূর্ণ অচেনা এক পথে হেঁটেছে। কাজেই, এই দফায় স্বাস্থ্যের অধিকারের প্রতিশ্রুতি দিলে তাকে গুরুত্ব না দেওয়া ভুল হবে।

দয়া থেকে অধিকার

গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে যেখানে গরিব মানুষের খাদ্যের সংস্থানের নীতি স্বাধীনতার পর থেকেই এই দেশে আছে, সেখানে একটা আইন তৈরি করে ‘খাদ্যের অধিকার’ দেওয়াকে আলাদা গুরুত্ব দেব কেন? সর্বশিক্ষা মিশনের মতো প্রকল্প যেখানে আছেই, সেখানে ‘শিক্ষার অধিকার’ নতুন কী করবে?

দয়া আর অধিকার এক নয়। ভারতে, আর পাঁচটা দেশের মতোই, উন্নয়নের যে নীতি এত দিন ছিল, তার ভিত্তি হল রাজনৈতিক সদিচ্ছা— যাঁরা শাসন ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা গরিব মানুষের কথা ভাবেন বলে তাঁদের জন্য সস্তায় খাবার, নিখরচায় শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। সেই সদিচ্ছার সঙ্গে নির্বাচনের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ, কারণ এখনও গরিব মানুষই ভোটার তালিকায় তুমুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কাছ থেকে জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলি পাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে নেতাদের মুখাপেক্ষী থাকতেই হয়।

ইউপিএ এই খেলাটাকেই বদলে দিয়েছে। ভবিষ্যতের কোনও প্রধানমন্ত্রী, তাঁর শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও, সংবিধান সংশোধন না করে খাদ্যের ভর্তুকি কমাতে পারবেন না। প্রাথমিক শিক্ষায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারবেন না। সদিচ্ছার সঙ্গে আইনের এই ফারাক অনতিক্রম্য। ভারতীয় রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্তের গুরুত্ব বাড়ছে। বস্তুত, নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে সমর্থনের যে ঢল নেমেছে, তা এই প্রবণতারই প্রত্যক্ষ ফল। গত দশ বছরে সমাজের একটা বড় অংশের গড় মাথাপিছু আয় বিস্তর বেড়েছে। ফলে, অনেকেরই রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা অনেক কমেছে। রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা পাল্টেছে— আগে যেখানে ভাত-কাপড়ের দাবি ছিল, এখন তা দাঁড়িয়েছে উচ্চতর আয়বৃদ্ধির হারের দাবি।

সেই দাবি অন্যায় নয়, উন্নতির শর্ত এটাই। কিন্তু নীচের দিকে থাকা মানুষগুলো এখনও খাদ্য-স্বাস্থ্য-শিক্ষার জন্যই রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী। তাদের দলে লোক কমছে, ফলে নির্বাচনী পাটিগণিতে তাদের জোরও কমছে। কে বলতে পারে, কয়েকটা নির্বাচন পেরিয়ে তারা ভোটের হিসেবে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়বে না? ভোটের অঙ্ক যখন আর রাজনীতিকদের সদিচ্ছা জাগাতে পারবে না, তখন ইউপিএ-র তৈরি করা আইন এই দুর্বলতম শ্রেণির সবচেয়ে বড় সহায় হবে। বৃদ্ধির হারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পুনর্বণ্টনের প্রশ্নটি যাতে কখনও হেরে না যায়, তা নিশ্চিত করা বড় মাপের বিপ্লব বইকী।

পুনর্বণ্টন বনাম বৃদ্ধি

পুনর্বণ্টনে জোর দিতে গিয়ে ইউপিএ কি বৃদ্ধির হারের সর্বনাশ করেছে? কিছু দিন আগে একটি লেখায় (‘ইউপিএ ২-ও এনডিএ-র তুলনায় বেশি সফল’, ১৮/৩, মৈত্রীশ ঘটক ও অমিতাভ গুপ্ত) দেখানো হয়েছে, বৃদ্ধির হারে ইউপিএ কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এবং, সেই বৃদ্ধির সুফল যাতে অপেক্ষাকৃত সুষম ভাবে বণ্টিত হয়, তা নিশ্চিত করার দিকেই নজর ছিল সরকারের। কিন্তু তার পরেও অভিযোগ উঠবে, পুনর্বণ্টনের খেলায় মেতে ইউপিএ ভর্তুকির বোঝা বাড়িয়েছে। ঠিকই, এনডিএ-র শেষ বছরে যেখানে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল জাতীয় আয়ের দেড় শতাংশের কাছাকাছি, ইউপিএ তাকে প্রায় আড়াই শতাংশে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি কী? রাজকোষ ঘাটতির হার এখন যে স্তরে রয়েছে, সেটা ভারতে রীতিমত স্বাভাবিক— এনডিএ-র শাসনকাল জুড়েই এই ঘাটতি জাতীয় আয়ের পাঁচ থেকে ছয় শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছিল। এখন ঘাটতি বরং সেই তুলনায় কম। এবং, ইউপিএ-র শাসনকালে রাজকোষ ঘাটতি বেড়েছে ২০০৮-০৯ সাল নাগাদ, যখন গোটা দুনিয়া মন্দার কবলে। তখন কেইনসীয় অর্থনীতিই উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র পথ ছিল, জগদীশ ভগবতীও স্বীকার করবেন।

অর্থনীতির অন্য মাপকাঠিগুলোর দিকে তাকানো যাক। এনডিএ-র তুলনায় ইউপিএ-র আমলে অনেক দ্রুত হারে মূলধন তৈরি হয়েছে ভারতে। পরিভাষায় যাকে গ্রস ক্যাপিটাল ফর্মেশন বলে, এনডিএ-র আমলে তার বৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার ছিল ২৫ শতাংশের কাছাকাছি, ইউপিএ-র আমলে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ শতাংশের ওপরে। এই হার যত বাড়বে, আর্থিক বৃদ্ধির হারও তত মজবুত হবে। ভারত যে আন্তর্জাতিক মন্দার তীব্রতম সময়েও দুনিয়ার সেরা দেশগুলির মধ্যে থাকতে পেরেছে, সেটা ভুলে যাওয়ার নয়। সঞ্চয়ের হারও বেড়েছে। এনডিএ-র আমলের ২৫ শতাংশ সঞ্চয়ের হার ইউপিএ-র জমানায় ৩৭ শতাংশে পৌঁছেছিল। এখনও সেই হার ৩২ শতাংশের কাছাকাছি। পরিকাঠামোয় বিনিয়োগের হার এনডিএ-র শেষ বছরে ছিল জাতীয় আয়ের ৪.৭৬ শতাংশ। ইউপিএ-র আমলে তা ৮.৪১ শতাংশে পৌঁছেছিল। লক্ষণীয়, এনডিএ-র সময় পরিকাঠামোয় বিনিয়োগের সিংহভাগ আসত রাজকোষ থেকে। ইউপিএ-র আমলে এই ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ এবং যৌথ বিনিয়োগের পরিমাণ অনেকটা বেড়েছে। সুতরাং কোনও হিসেবেই বলার উপায় নেই, ইউপিএ সরকার পুনর্বণ্টনে জোর দিতে গিয়ে আর্থিক ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।

বহুমুখী লাভ

গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার মতো প্রকল্পে যে বিপুল খরচ, তাতে কাজের কাজ কতটুকু হচ্ছে? মানুষের লাভ হচ্ছে? গ্রামীণ সম্পদ তৈরি হচ্ছে? জঁ দ্রেজ ও অমর্ত্য সেন (‘ইন্ডিয়া: অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি’) গ্রামাঞ্চলে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির একটা হিসেব দিয়েছেন। ২০০০-০১ থেকে ২০০৫-০৬ পর্যন্ত, অর্থাৎ গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প চালু হওয়ার আগে, এনডিএ-র শাসনকালে, গ্রামীণ শ্রমিকদের বছরে প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হার ছিল ০.১ শতাংশ। মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তো প্রতি বছর মজুরি কমত। এই বছরগুলো কিন্তু এনডিএ-র ‘ভারত উদয়’-এর বছর! এই প্রকল্প চালু হওয়ার পর অ-কৃষি ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মজুরি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেড়েছে তো বটেই, কৃষি ক্ষেত্রেও (যেখানে এই যোজনা প্রযোজ্য নয়) প্রায় তাল মিলিয়ে বেড়েছে। সবচেয়ে লাভ হয়েছে মহিলা শ্রমিকদের। আগে অ-কৃষি ক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি বছরে ০.০৫% হারে কমছিল, ২০০৫-০৬ থেকে ২০১০-১১ পর্যন্ত বছরে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে ৪.৩৪% হারে। ফলে গ্রামাঞ্চলে ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, জীবনযাপনের মান বেড়েছে। একে সাধারণ মানুষের লাভ বলব না?

আর্থিক সংস্কারের পর থেকেই ভারতে সুস্থায়ী ভাবে দারিদ্র কমছে। ইউপিএ-র আমলে এসে দারিদ্র হ্রাস পাওয়ার হার অনেকখানি বেড়েছে। ইউপিএ-র দশ বছরে ভারতে বছরে গড়ে ২.১৮% হারে দারিদ্র কমেছে। আগের দশ বছরে এই হার ছিল বছরে ০.৭৪%।

প্রকল্পের জন্য যত টাকা বরাদ্দ হয়, তার সবটাই নিশ্চয় শ্রমিকদের হাতে পৌঁছয় না। দুর্নীতি আগেও ছিল, পরেও আছে। গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনায় দুর্নীতির বড় উৎস ভুয়ো কাজ দেখিয়ে তার পয়সা আত্মসাৎ করা। তবে, সেই প্রবণতা কমছে। অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সাম্প্রতিক লেখায় কিছু তথ্য পেশ করেছেন। যেমন, বিহার এবং রাজস্থানে সমীক্ষা করে তাঁরা দেখেছেন, সম্পূর্ণ ভুয়ো প্রকল্প কার্যত একটিও নেই। অন্ধ্রপ্রদেশে অন্য একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কর্মসংস্থান প্রকল্পে যত লোকের নামে টাকা বরাদ্দ হয়েছে, তাদের মাত্র ১১ শতাংশকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই ১১%-র সবাই ভুয়ো হলেও প্রায় ৯০% ঠিক লোকের কাছে কর্মসংস্থান যোজনার টাকা পৌঁছচ্ছে, এটা কম কথা নয়। অমর্ত্য সেনও জোর দিয়ে বলেছেন, গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে গ্রামীণ সম্পদ নির্মিত হচ্ছে না, এটা নিতান্ত বাজে কথা।

সম্ভাবনার দিগন্ত

আর একটি কথা সংক্ষেপে বলা যাক। ‘আধার কার্ড’ নামক প্রকল্পটি ভারতের উন্নয়নের অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তর প্রকল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ, লাতিন আমেরিকায় তার উদাহরণ পাওয়া গিয়েছে। ‘আধার কার্ড’-এর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের কাজ ভারতে পুরোদমে আরম্ভ হলে তার চেহারা কী হবে, অর্থনীতিবিদ কার্তিক মুরলীধরন ও তাঁর দুই সহকর্মীর পরীক্ষায় তার একটা আভাস পাওয়া গিয়েছে। তাঁরা দেখেছেন, বায়োমেট্রিক কার্ডের (যাকে আধার কার্ডের পূর্বসূরি বলা যেতে পারে) মাধ্যমে মজুরি পাওয়া গেলে টাকা পেতে প্রায় ২০ শতাংশ কম সময় লাগে, দুর্নীতি অনেকখানি কমে। প্রকল্পের বরাদ্দ এক পয়সাও না বাড়িয়ে যোজনায় মজুরির পরিমাণ প্রায় ২৩ শতাংশ বাড়ানো গিয়েছে এই পদ্ধতিতে। ‘আধার’ ভবিষ্যতের পথ। এই ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়ার কৃতিত্ব ইউপিএ সরকারের।

সামাজিক ক্ষেত্রে পুনর্বণ্টনের প্রশ্নে ইউপিএ যে শুধু অনেক পথ হেঁটেছে, তা-ই নয়— বহু স্তরে এক নতুন যুগের সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছে। এই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকেই ইউপিএ-র দশ বছর ভারতের উন্নয়ন অর্থনীতির ইতিহাসে খুব বিশিষ্ট একটি অধ্যায় হিসেবে থাকবে।

ইতিহাস সম্ভবত মনমোহন সিংহের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি সদয়তর হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amitabha gupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE