Advertisement
০৫ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

উচিত শিক্ষা

মামলায় হারিয়া যাওয়া এক কথা। আর মামলা করিতে গিয়া ‘ইহা কোনও মামলাই নয়’ বলিয়া বিচারকের কাছে ভর্ত্‌সিত হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। ইহাতে শুধু পরাজয় ঘটে না: চূড়ান্ত অপমানিত হইতে হয়, নাক ঘষিয়া যায়। সাধারণত যাঁহারা সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়িতে যান, এই অপমান তাঁহাদের সহিতে হয় না। দারিদ্রলাঞ্ছিত দেশের স্বল্পশিক্ষিত মামলাকারীরাও জানেন, বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরটিতে বিচার চাহিতে হইলে যথাযোগ্য আইনি পরামর্শ-সহকারে প্রস্তুত হইয়া যাওয়াই ভাল।

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

মামলায় হারিয়া যাওয়া এক কথা। আর মামলা করিতে গিয়া ‘ইহা কোনও মামলাই নয়’ বলিয়া বিচারকের কাছে ভর্ত্‌সিত হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। ইহাতে শুধু পরাজয় ঘটে না: চূড়ান্ত অপমানিত হইতে হয়, নাক ঘষিয়া যায়। সাধারণত যাঁহারা সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়িতে যান, এই অপমান তাঁহাদের সহিতে হয় না। দারিদ্রলাঞ্ছিত দেশের স্বল্পশিক্ষিত মামলাকারীরাও জানেন, বিচারব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরটিতে বিচার চাহিতে হইলে যথাযোগ্য আইনি পরামর্শ-সহকারে প্রস্তুত হইয়া যাওয়াই ভাল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চিত ভাবেই সর্বাদপি গরীয়সী: সাধারণ ধ্যানধারণার অনেক বাহিরে তাঁহার মনোভাব ও মতামত। কাহারও কথা শোনায় তিনি কদাপি বিশ্বাসী নহেন, পরামর্শ গ্রহণের বিনয় তাঁহার স্বভাবে নাই। সারদা মামলার সিবিআই তদন্ত বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মামলাটির বক্তব্য শুনিয়া সুপ্রিম কোর্ট যাহা বলিয়াছে, তাহা অপ্রত্যাশিত ছিল না। জনশ্রুতি: মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁহার সচিব এবং প্রশাসনিক আমলারা আগেই সতর্ক করিয়াছিলেন, তিনি কর্ণপাত করেন নাই; আইনজ্ঞরা বোঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, তিনি মানেন নাই; নেতারা রাজনৈতিক ক্ষতির ভয় পাইয়াছিলেন, তিনি পাত্তা দেন নাই। ফল যেমন হইবার তেমনই হইয়াছে। সিবিআই তদন্তে যখন গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া যায় নাই, কেবল নেত্রীর ইচ্ছায় সুপ্রিম কোর্ট তদন্তে নজরদারি করিতে রাজি হয় নাই। পাশাপাশি, সংবাদমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করিয়া কোনও বেআইনি কাজ করিতেছে, ইহা প্রতিষ্ঠা করা যায় নাই বলিয়া সংবাদমাধ্যমের উপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করিবার দাবিটিও সুপ্রিম কোর্টের বোধগম্য হয় নাই। সর্বোপরি, সিবিআই-এর মামলা লহিয়া রাজ্য সরকার কেন এত দুর্ভাবিত, সেই মৌলিক প্রশ্নটিরও সঙ্গত উত্তর মিলে নাই।

রাজ্য সরকারের পক্ষে যে আইনজীবী লড়িতেছিলেন, তিনি যে সে নহেন। মৌলিকতম প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে তিনিও অক্ষম হইয়াছেন, ইহা মামলাটির বায়বীয়তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। কোনও মামলা করিতে গেলে মামলাটি আদৌ দাঁড়ায় কি না, প্রথমেই ইহা ভাবিয়া লইবার আরও একটি কারণ থাকে। কারণটি আর্থিক। সুপ্রিম কোর্টে মামলা চালাইবার ব্যয় বহন করিবার যুক্তিযুক্ততাটিও ভাবিতে হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশ্নটি ওঠে নাই। রাজ্য সরকারের মামলা ব্যয় বহন করিবে সরকারি কোষাগার, অর্থাত্‌ সাধারণ মানুষের পকেট। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীর ভাবনা কী! সিবিআই মামলা আটকাইবার জন্য আগেও তিনি বিস্তর সরকারি অর্থ খরচ করিয়াছেন, এ বারেও না হয় করিলেন। অর্থের পরিমাণটি অবশ্যই সুপ্রচুর, কপিল সিব্বল তো ঠিক আমজনতার উকিল নহেন! যাহা হউক, মুখ্যমন্ত্রীর এই মামলা-বিলাস কেবল মূর্খামি বলিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়া মুশকিল। ইহা অনৈতিক। তিনি ও তাঁহার দল সিবিআই মামলা নামক জুজুর ভয় পাইতেছেন বলিয়া সমগ্র রাজ্যকে এই ক্ষয় ও ক্ষতি বহন করিতে হইবে?

যিনি এই মাপের অন্যায় ও অনাচার করিতে পারেন, তাঁহার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ কোন সর্বনাশা অতলে ডুবিতেছে, তাহা সহজেই বোধগম্য। নেত্রী নিজেকে বিধাত্রী ভাবেন। ইহা ভ্রমের লক্ষণ নহে, অসুস্থতার লক্ষণ। উপর্যুপরি ঘটনায় প্রমাণিত, সেই বিধাত্রী ‘ইগো’ দ্রুত অসংবরণীয় পর্যায়ে পৌঁছাইতেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আইনতান্ত্রিক শাসন ইত্যাদি শব্দবন্ধ তাঁহার কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন, তিনি তাঁহার বোধ বুদ্ধি মত ইচ্ছা লইয়া সর্বময়ী কর্ত্রী। এই একচ্ছত্রতাও হয়তো সহনীয় হইত, যদি ঠিকঠাক লক্ষ্যে তিনি নিজেকে চালিত করিতেন। কিন্তু নিজের জেদ প্রতিষ্ঠা করিতেই যদি সময় বহিয়া যায়, ঠিকঠাক কাজ হইবে কখন? সুপ্রিম কোর্টের রায় তিনি শুনিয়াছেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শটি শুনিয়াছেন কি? মহামান্য বিচারপতিরা কিন্তু একটি মূল্যবান পরামর্শও দিতে ভুলেন নাই: সিবিআই সিবিআই-এর কাজ করিতেছে, আদালত আদালতের কাজ করিতেছে। সরকারের কাজ সরকার করুক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE