Advertisement
E-Paper

উৎকর্ষের সাধনা আমরাও জানতাম

অর্ধ শতাব্দী আগেও প্রেসিডেন্সি আর কেমব্রিজের তফাত ছিল, কিন্তু জ্ঞানচর্চার প্রশ্নে দুই প্রতিষ্ঠানেই কোনও আপস ছিল না। কেমব্রিজ আজও মহিমময়, আমাদের সম্বন্ধে সে কথা বলা চলে কি?প্রেসিডেন্সি কলেজ, ১৯৬১ সাল। বেকার ল্যাবরেটরিতে, পদার্থবিদ্যার ছাত্র, বয়স সবে মাত্র ষোলো বছর। নকশাল আন্দোলন তখনও দিগন্তের ও পারে। কিন্তু রমরমা চালু হয়েছে, এমনকী আমাদের ক্লাসেই। লেফট রাজনীতি মজ্জায় মজ্জায়। এই নীতি থেকেই বঙ্গভূমি তথা সারা ভারতবর্ষ একটি ইউটোপিয়ায় পৌঁছে যাবে, আমাদের মতন নবীনদের এটাই হল সে যুগের ধ্যানধারণা এবং আশা।

বিকাশ সিংহ

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
দুই পৃথিবী। প্রেসিডেন্সি (বাঁ দিকে) এবং কেমব্রিজ।

দুই পৃথিবী। প্রেসিডেন্সি (বাঁ দিকে) এবং কেমব্রিজ।

প্রেসিডেন্সি কলেজ, ১৯৬১ সাল। বেকার ল্যাবরেটরিতে, পদার্থবিদ্যার ছাত্র, বয়স সবে মাত্র ষোলো বছর। নকশাল আন্দোলন তখনও দিগন্তের ও পারে। কিন্তু রমরমা চালু হয়েছে, এমনকী আমাদের ক্লাসেই। লেফট রাজনীতি মজ্জায় মজ্জায়। এই নীতি থেকেই বঙ্গভূমি তথা সারা ভারতবর্ষ একটি ইউটোপিয়ায় পৌঁছে যাবে, আমাদের মতন নবীনদের এটাই হল সে যুগের ধ্যানধারণা এবং আশা।

কিন্তু, পড়াশুনোর জগতে উৎকর্ষের বিন্দুমাত্র অভাব ছিল না। নামকরা, এমনকী বিশ্ববিশ্রুত অধ্যাপকরা আমাদের পড়িয়েছেন। অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীর নামে একটি রায়চৌধুরী সমীকরণও ছিল। এঁরা শুধু মনপ্রাণ ঢেলে নিখুঁত ভাবে পড়াতেন, তা-ই নয়, পড়ানোটা যে উচ্চ স্তরের একটি সাধনা, সেটা সাধারণ ছাত্রদেরও বুঝতে বিন্দুমাত্র সময় লাগেনি। প্রত্যেকটি অধ্যাপক নতুনকে জানবার জন্য এক অদম্য প্রেরণার উৎস ছিলেন। আজ থেকে সে যুগটা মোটামুটি পঞ্চাশ বছর আগেকার। কিন্তু এখনও ওই দিনগুলি স্পষ্ট ভাবেই মনের চোখে ভাসছে। আন্দোলন বলে কিছু ছিল না, কিন্তু রাজনীতি-ঘেঁষা তর্কবিতর্কের কোনও অভাবও ছিল না। সেই তর্কের গভীরে রাজনৈতিক দর্শনের ছাপ থাকত। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে লাগামছাড়া স্বাধীনতার কোনও স্থান ছিল না। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে ক্লাস করব না, এমন মনোবৃত্তি তখন কাছে ঘেঁষতে পারেনি।

পরীক্ষাতেও কেবল মুখস্থবিদ্যার জোরে ভাল করব, সে হাওয়াও তখন বইতে শুরু করেনি। পদার্থবিদ্যার জগতে যে কোনও বিষয় ভাল করে বুঝব, গভীরে যাব, সেখানে ফাঁকির কোনও ঘর নেই, এই ব্যাপারটা ছাত্রদের মজ্জায় পৌঁছে গিয়েছিল। প্রেসিডেন্সির পরিবেশে উৎকর্ষের মর্যাদা ছিল। সেটা না হলে ভাল ছাত্ররা আসবেই বা কেন? কিন্তু পুরু কাচের চশমা পরে পড়ুয়া হয়েই যথেষ্ট হল, এমন চিন্তারও কোনও ঠাঁই ছিল না। খেলাধুলা, ডিবেট, কফিহাউসে জমানো আড্ডা, সুন্দরী মহিলাদের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকা, এ সবই ছিল সে কালের প্রেসিডেন্সি কলেজের পাঠক্রমের একটা অংশ।

আর ছিল আমাদের ঐতিহ্যগৌরব। আচার্য জগদীশচন্দ্র, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, সুভাষ বসু, অমর্ত্য সেন, তারক সেন, এই কলেজেরই মানুষ। ইতিহাসে এক একটি বিগ্রহ। আমাদের জীবনে এঁদের এক সময়ের উপস্থিতির কথা ভেবে মন ভরে উঠত। এঁদের প্রতিভার ছটা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। কলেজে ছাত্র হিসেবে থাকাকালীন প্রত্যেকটি দিন মনে হত একটা নূতন দিন। কারণ, আগামী কাল হয়তো নতুন কিছু শিখব, কিংবা শীতের সময়, সেন্ট জেভিয়ার্সের বিরুদ্ধে একটা সেঞ্চুরি মেরে দেব কিংবা ডিবেটে একটা জোর পয়েন্ট মারব, কিংবা অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরীর স্পেশাল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি-র ওপর লেকচার শুনব, কিংবা অধ্যাপক শ্যামল সেনগুপ্তের থার্মোডায়নামিক্স-এর ক্লাসে। সময়ের তির আর এনট্রপির তির একই দিকে ছুটছে। তার ভাবমূর্তিটি কী, বোঝবার চেষ্টা করব। কিংবা, অধ্যাপক তারক সেনের লেকচার, সেখানেই ইংরাজি সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচিতি। মন মোহিত করতেন, যখন শেক্সপিয়র পড়াতেন। অবশ্যই বলতে হবে, গোটা ব্যাপারটা মন ভরিয়েছিল।

তিন বছর নিমেষেই প্রায় কেটে গেল। কলেজ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে ডিপার্টমেন্টের যিনি হেড, অধ্যাপক রাজেন সেনগুপ্তকে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এ বার কি স্যার?’ ওঁর খোনা খোনা গলায় বললেন, ‘ছেড়ে দিলাম, চরে খাও’, আর তার পরেই, ‘If you want to do physics, you will starve.’ কিন্তু বেকার ল্যাবরেটরির উৎকর্ষ তো মনের গভীরে রেখাপাত করেছে, কাজেই পদার্থবিদ্যা ছাড়া গতি নেই।

অতএব, না খেতে পেয়ে মরব, এই দুশ্চিন্তা মাথায় রেখে সাত সমুদ্র উড়ে গিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হলাম উনিশ বছর বয়সে। ক্রাইস্ট’স কলেজে। ১৯৬৪ সাল। শুনেছিলাম উৎকর্ষ সেখানে সীমাহীন। শোনা কথা এবং বাস্তবের মধ্যে কোনও তুলনাই হয় না, কিন্তু কেমব্রিজে বাস্তবের উপলব্ধি শোনা কথা থেকে অনেক গুণ প্রবল। প্রথমেই লক্ষ করলাম অপার স্বাধীনতা। যে কোনও ছাত্র যা ইচ্ছে করতে পারে। কিন্তু কোথায় পরোক্ষে, নিভৃতে এমনই একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে শত শত বছরের উঁচু স্তরের অভিজ্ঞতায় যে, ভাল না করে নিস্তার নেই। লেখাপড়ায়, গবেষণায়, খেলাধুলায়, কেমব্রিজ ইউনিয়ন ডিবেটে। কী ক্লাসঘরে, কী খেলার মাঠে, এমনকী নাচঘরেও, কী গানবাজনার আসরে— ভাল তোমাকে করতেই হবে। আর তারই সঙ্গে পরিবেশের কী অপূর্ব সৌন্দর্য! লম্বা লম্বা গাছ, তাদের শান্ত স্নিগ্ধ ঝিরঝিরে হাওয়া গরমের সময়, ক্যাম নদীর ধার বেয়ে হেঁটে বেড়ানো, মন-প্রাণ জোড়ানো পরিবেশ। কিন্তু বালকসুলভ দুষ্টুমিরও শেষ নেই। অনেকটা প্রেসিডেন্সিরই মতো এক হিসেবে প্রত্যেকটি দিন একটি নতুন দিন, গতকাল আর আজকের মধ্যে অনেক পার্থক্য। আবার, আগামী কালের হাতছানির কথা ভেবেই শুতে যাওয়া হত, কারণ আগামিকাল তো আবার নতুন কিছু দেব। ভাল কিছু করতেই হবে। যেন একটা যন্ত্রণা সব সময় মনের মধ্যে। এই যন্ত্রণা উচ্চস্তরের শিক্ষার এক মাপকাঠি।

আর হ্যাঁ, তাক লাগল অধ্যাপকদের সান্নিধ্যে আসতে পেরে। অধ্যাপক, আরি বাপ্স, স্যার নেভিল মট। নোবেলজয়ী। অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত স্টিফেন হকিং। কিছুটা পাগলাটে, খ্যাপাটে, কিন্তু বুদ্ধি মেধা টগবগ করছে। অমর্ত্য সেন ট্রিনিটি কলেজে, ভারতীয়-ঘেঁষা জোন রবিনসন আমাদের নিজেদের কলেজের (ক্রাইস্ট’স কলেজ) মাস্টার লর্ড টঢ্, নোবেলজয়ী ছাত্রদের ক্লাব। নাক-উঁচু ছাত্রদের বিশেষ বিশেষ ক্লাব, যেমন পিট ক্লাব। তারই সঙ্গে আগোছালো চুল। প্রথম তখন জিনসের খেলা। সে কালের যুগের বিটলদের তাণ্ডব নৃত্য আর কান-ফাটানো বাজনা, সব মিলিয়ে এক রঙিন মেলা বসেছে যেন। কিন্তু ওই, আনাচেকানাচে উৎকর্ষের তীব্র চাপ।

ডিসেম্বর ২০০৮। আবার ডাক পড়ল কেমব্রিজে। প্রচণ্ড ঠান্ডা, কিন্তু শীতের সেই হাওয়াতেও একটা ঝিরঝিরে আনন্দ আছে। আমরা গিয়েছি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর মর্মর মূর্তির স্থাপনা উপলক্ষে। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তা অধ্যাপক শিবাজী রাহার সৌজন্যে। জগদীশচন্দ্র ওই কলেজেরই ছাত্র। মর্মর মূর্তি বসল তৃতীয় উঠোনে। কার্পেরেস-সাইপ্রাস গাছের নীচে, গালে হাত, দৃষ্টি বহু দূর পর্যন্ত। তার বিপরীতেই চার্লস ডারউইনের মূর্তি। একটি সামান্য বেঞ্চে বসে আছেন তিনি, তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে দেখছেন জগদীশচন্দ্রকে। প্রসঙ্গত বলি, এই তৃতীয় উঠোনটির সংস্থান করেছেন সিপ্লা নামক ওষুধ কোম্পানির স্বনামধন্য কর্ণধার ইউসুফ হামিদ।

২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪। ঠিক পঞ্চাশ বছরের মাথায় আমাদের কলেজে নৈশভোজের আয়োজন। সেই সময়হীন কেমব্রিজ, সুন্দর খাবার, সুন্দর কথা, সুন্দর ভাষণ, যেন পঞ্চাশ বছর নিমেষে কোথায় উধাও হয়ে গেল। সেই পঞ্চাশ বছর আগের বন্ধুত্বের গভীরতা এক মুহূর্তের মধ্যেই ফিরে এল। নিজেকে আবার উনিশ বছরের তরুণ মনে হল।

প্রেসিডেন্সি নিয়েও একটু আশা মনে জেগেছে। কিন্তু পুরনো উৎকর্ষ নতুন করে সাজিয়ে আনতেই হবে প্রেসিডেন্সিতে। তা না হলে আশাটুকুই থেকে যাবে।

ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এ হোমি ভাবা অধ্যাপক

bikash sinha presidency university presidency
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy