বছর দশেক আগে বিঘে দুয়েক জায়গাতে ‘প্রসেসিং’ আলুর চাষ শুরু করি। এই আলু প্রক্রিয়াকরণ বা ‘প্রসেসিং’ হয়ে চিপস হয়, তাকেই চলতি কথায় বলে প্রসেসিং আলু। তখন সাঁইথিয়ার অভেদানন্দ মহাবিদ্যালয়ে বিএ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ২০০৮ সালে সিমলার সেন্ট্রাল পটেটো রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে আলু চাষের প্রশিক্ষণ নিই। পরে পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে এমএ, ইগনু থেকে এমবিএ করি। ঠিক করি, চাষটাই পেশা হিসেবে নেব।
আমাদের বনগ্রাম পঞ্চায়েতের বড়া গ্রামে তখনও চাষিরা বাজারচলতি জ্যোতি, পোখরাজ, সুপার-৬ আলু চাষ করে যাচ্ছিলেন। ২০০৬-০৭ সালে দেখলাম, আলু ফলিয়ে অনেকের প্রচুর ক্ষতি হল। তার পরের বছর অনেক আগে থেকে সবাইকে ‘প্রসেসিং আলু’ চাষ সম্বন্ধে বোঝাতে শুরু করলাম। তাঁরা আস্তে আস্তে আগ্রহী হন। বনগ্রাম পঞ্চায়েতের বড়া, তিলপাড়া, চরুটিয়া, সাঁকিড়েপাড়, ধোবাগ্রাম, বামনিগ্রাম, এবং হরিসাড়া পঞ্চায়েতের ভবানীপুর, কালা প্রভৃতি গ্রামে এ বছর একশোরও বেশি চাষি চারশো বিঘা জমিতে এই আলুর চাষ করেছেন। ‘প্রসেসিং’ আলুর নানা প্রজাতির নাম এটিএল, চিপসোনা-১, এফসি-৩, প্রভৃতি। এ বছর যখন প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে, তখনও প্রসেসিং আলু চাষ করে আমরা বিঘে প্রতি ১৫-২০ হাজার টাকা লাভ করেছি।
চাষের শুরুর আগেই আলু চিপস তৈরির একটি বেসরকারি কোম্পানি আমাদের সঙ্গে বসে একটি ক্রয়মূল্য ঠিক করে নিয়ে একটি চুক্তি সই করায়। এ বছর ক্রয়মূল্য ৪০০ টাকা প্রতি ব্যাগ (৫০ কেজির বস্তা)। কোম্পানিই বীজ, সার, কীটনাশক সরবরাহ করে। এমনকী কোম্পানিকে বললে মেশিনে করে জমিতে আলু লাগিয়ে দেয়, তুলেও দেয়। সে ক্ষেত্রে চাষিকে মেশিনের ভাড়া দিতে হয়। জমি থেকে যখন ঘরে ফসল ওঠে তখন মোট দাম থেকে বীজ, সার, কীটনাশকের দাম ও মেশিনের ভাড়া কেটে নেওয়া হয়। কেবল মজুরির খরচ বহন করতে হয় চাষিকে। তবে যে সব আলু ৪৫ মিলিমিটার বা তার বেশি মাপের, সেগুলোই নেয় কোম্পানি। আলু সবুজ থাকলেও নেয় না। উৎপাদনের ৮০ শতাংশই কেনে কোম্পানি। বাকিটা খোলা বাজারে বিক্রি হয়। জ্যোতি বা পোখরাজ আলুর চেয়ে এতে চিনির পরিমাণ কম থাকে, তাই এই আলুর দামও কিলোগ্রামে ২-৩ টাকা বেশি।
সার, কীটনাশকের খরচ, আর মজুরি মিটিয়েও চুক্তি-চাষে ৫০-৬০ শতাংশ লাভ থাকে। প্রতি বছরই কোম্পানি ক্রয়মূল্য একটু একটু করে বাড়াচ্ছে। তা ছাড়াও হিমঘরে আলু রাখার ঝক্কি পোহাতে হয় না, সরাসরি জমি থেকেই আলু নিয়ে যায় কোম্পানি। ফলে গত পাঁচ-সাত বছর ধরে এই আলু চাষ করে আমরা ক্ষতির মুখ দেখিনি।
বাড়তি লাভ: কোম্পানি প্রযুক্তি সহায়তা দেয়; প্ল্যান্টার, হার্ভেস্টার, এগুলো ব্যবহার করতে শেখায়। ২৫ একর জমিতে আমি এই সব যন্ত্র ব্যবহার করে বিঘেতে দু’তিন হাজার টাকা মজুরি খরচ বাঁচাতে পেরেিছ। হার্ভেস্টারে আলু তুললে মাঠে আলু নষ্ট হওয়া কমেছে পাঁচ-দশ শতাংশ।
চুক্তি-চাষের সুবিধে এই যে, আগেই চাষি বুঝতে পারে যে সে কতটা লাভ করবে। আলুর বাজার প্রতি বছর ওঠানামা করে, ফাটকাবাজি হয়। কিন্তু চুক্তি-চাষ হলে নিশ্চিন্ত থাকা যায় যে, নির্দিষ্ট লাভ থাকবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ধসা-র মতো রোগের জন্য আলু নষ্ট না হলে, লাভ হবেই। ঠিক মতো উৎপাদন হলে রাজ্যের আলু উদ্বৃত্ত হয়ে যায়। তাই আমার মনে হয়, প্রতি চাষি যতটা জমি চাষ করেন, তার কিছু যদি চুক্তি চাষ করেন, তা হলে তাঁর ঝুঁকিটা কমে আসবে।
আলুর লাভজনক বিকল্প চাষ কী, তা এখনও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। ভুট্টা কিংবা সব্জি চাষেও যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে। সে ঝুঁকি আলু চাষের চাইতে কম নয়। টম্যাটো, শসাও রাস্তায় ঢেলে দিতে হয় চাষিদের। তার চাইতে আলু লাগিয়ে চুক্তি চাষে যাওয়া চাষিদের জন্য ভাল।
সাক্ষাৎকার: অনির্বাণ সেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy