Advertisement
০৪ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

এক নির্ভার সাতরঙা দেশের খোঁজে

আশির দশকের শেষ দিকে এ রাজ্যের প্রান্তে একটি আবাসিক স্কুলের ঘটনা। সিনেমা বলতে তখনও সেখানে কবেকার ভক্ত ধ্রুব, বিয়াল্লিশের বিপ্লব কি বড়জোর বাদশা, জয়জয়ন্তী বোঝা হত। কোন জাদু পাসওয়ার্ডে কে জানে, সেই লৌহকপাট ভেদ করে এক বিকেলে শেখর কপূরের ‘মাসুম’ ঢুকে পড়ল।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৪৯
Share: Save:

আশির দশকের শেষ দিকে এ রাজ্যের প্রান্তে একটি আবাসিক স্কুলের ঘটনা। সিনেমা বলতে তখনও সেখানে কবেকার ভক্ত ধ্রুব, বিয়াল্লিশের বিপ্লব কি বড়জোর বাদশা, জয়জয়ন্তী বোঝা হত। কোন জাদু পাসওয়ার্ডে কে জানে, সেই লৌহকপাট ভেদ করে এক বিকেলে শেখর কপূরের ‘মাসুম’ ঢুকে পড়ল।

অতঃপর দু-চার জন ডেঁপো ছোঁড়া, যারা ইতিমধ্যেই ছুটিতে বাড়ি গিয়ে ভিসিপি-তে সে ছবি দেখার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফেলেছে, তাদের মুখ টিপে সারা ক্ষণ ফিচেল হাসি। না-বুঝে যাঁরা ছবিটি বাছাই করেছিলেন, হাঁ-করে তাকিয়ে তাঁরা কিংকতর্ব্যবিমূঢ়! তত ক্ষণে পতিদেবের বিয়ে-বহির্ভুত কীর্তি নিয়ে দাম্পত্যে জট, সুখী পরিবারের ভাগ্যাকাশে বিনা মেঘে বজ্রপাতের গেরোয় ছবিটি জমে উঠেছে। শেষমেশ অবশ্য মাঝপথেই ‘শো’ থামানো হল। যে জন্য ছবিটি স্কুলে দ্রষ্টব্য বলে ভাবা হয়েছিল, ছোটদের সেই সমান্তরাল জগত, তিন শিশুর অনাবিল খুনসুটি, দুষ্টুমির অংশ ছাত্রদের অদেখা থেকে গেল। এবং তথাকথিত অবৈধ সন্তানটিকে আপন করে নিয়ে পরিবারটির আবার সুখী হয়ে ওঠার স্বস্তির মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষার সাহস কেউই দেখালেন না।

‘হাইওয়ে’ ছবিটি দেখে এত বছর বাদে এই ভুলে যাওয়া ঘটনা মনে পড়ে হাসিই পেল! এ যুগে স্কুলের উঁচু ক্লাসের পড়ুয়াদের সামনে ‘মাসুম’ কতটা অস্বস্তিতে ফেলত, সে প্রশ্নে ঢুকতে চাই না। ভাবছিলাম, দুটো ছবির টানাপড়েন নিয়ে। দুটি ছবি জুড়েই সেই পরিবার। মাসুম-এর শিশুটি শেষ পর্যন্ত তার নতুন পরিবারে মিশে গেলেও হাইওয়ে-র মেয়েটির নাড়ি জন্মের মতো ছিঁড়ে যায়। ভয়ানক দুষ্কৃতীদের হাতে অপহরণের পরে তাকে ‘উদ্ধার’ করা গেলেও ঘরের মেয়ে আর ঘরে ফেরে না। পরিবারের শাসন, স্নেহ এবং পীড়নের চেহারাটাও চিনে নিয়ে যাবতীয় চাপ কাটিয়ে শুরু হয় তার নতুন জীবনের অভিযান।

এমন নয় যে পরিবারের সুরক্ষিত ঘেরাটোপকে এই প্রথম বাতিল করার স্পর্ধা দেখাল মেনস্ট্রিম হিন্দি ছবি। জাহাজের গায়ে ফুটোর চেহারা আগেও বার বার উঠে এসেছে। কিন্তু মাসুম-এর জমানার পরিবার আর আজকের হাইওয়ে-র পরিবারে ঢের ফারাক। গত দেড়-দু’দশকে বলিউডে পরিবার মানে তো শুধু পরিবার নয়! তা ক্রমশ এক সুরক্ষিত মজবুত রাষ্ট্রের কল্পকামনায় একাকার। ’৯০-এর দশকের মাঝপর্ব থেকেই সেলুলয়েডে দ্য বিগ ফ্যাট ইন্ডিয়ান (পড়ুন, হিন্দু) ওয়েডিং-এর জয়জয়কার। বিয়ের জমকালো আচার-অনুষ্ঠানের মোড়কে হিন্দু পারিবারিক মূল্যবোধের উৎসব। রামজন্মভূমি আন্দোলনের হাত ধরে বিজেপি-র উত্থান ও প্রায় একই সময়ে সিনেমায় হিন্দু পরিবারের মাহাত্ম্যপ্রচার নেহাতই কাকতালীয় নয়। পরিবার মানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। বড় ছাতার মতো সুখী পরিবার যেন সুখী রাষ্ট্রেরই প্রতীক। এ যুগে বিয়ের বাইরে যৌনতা, লিভ-ইন সম্পর্ক নিয়ে বলিউডের আড়ষ্টতা অনেকটাই ঘুচেছে ঠিকই। তবু সে-দিনের ‘হম আপকে হ্যায় কউন’ থেকে শুরু করে টিভি-র নিত্যনতুন ফ্যামিলি গেম শো অবধি পরিবারের আধিপত্যের ধারা এখনও অটুট।

তেমনই একটি পরিবারে বিয়ের ধূমধাম চলতে চলতেই ইমতিয়াজ আলির ‘হাইওয়ে’ উলটো পথে হাঁটতে শুরু করে।

গত শতকের শেষে ‘ফায়ার’ আর ‘ওয়াটার’-এও পারিবারিক স্থিতির সৌধকে চ্যালেঞ্জ ছোড়া হয়েছিল। দুই জায়ের সমকামী সম্পর্ক বা হিন্দু বাল-বিধবার পীড়ন নিয়ে ছবি গৈরিক মতাদর্শধারীদের তোপের মুখে পড়ে। বছর ১০-১২ আগের মনসুন ওয়েডিং-ও হালকা চালেই বিয়ে কিংবা পরিবারের রং করা কামরার দেওয়ালে জোড়াতালি দেওয়া তাপ্পিগুলো শনাক্ত করেছিল। বিয়ের মধুরেণ সমাপয়েতেও খসে-পড়া পলেস্তরার চিহ্ন দিব্যি মালুম হয়। কয়েক মাস আগের ছবি দ্য লাঞ্চবক্স-এ এক নিপাট গৃহবধূ মিথ্যে বিয়ের ভার বয়ে না-বেড়িয়ে মঙ্গলসূত্রসুদ্ধ গয়না বেচে নতুন জীবন শুরুর কথা বলেছেন।

আর হাইওয়ে-র নষ্টনীড়ের গল্প সুখী পরিবারের একপেশে ধারণা ছুড়ে ফেলে আর একটি সমান্তরাল দেশের গল্পে ঢুকে পড়ে।

না, স্রেফ ইন্ডিয়া আর ভারতের চেনা টানাপড়েনের মোড়কে এই সফরকে দেখাটা বোধহয় ঠিক হবে না। এত দিন বাড়ির আরামময় চৌহদ্দি কি হোটেলের ঝকঝকে স্যুইটে বন্দি দিল্লির বড়ঘরের মেয়েটির কাছে অবশ্যই এ এক নতুন দেশের সন্ধান। কিন্তু সে দেশ কোনও একটেরে ভারতীয়ত্বের চারণভূমি নয়।

দিল্লির উপকণ্ঠ থেকে পঞ্জাব, রাজস্থান হয়ে কলকাতা, বাংলা ছুঁয়ে ফের ম্যাপের ওপরের দিকে উঠছে অপহরণকারীর ট্রাক। রুটটা ঈষৎ গোলমেলে, পুরোটা বাস্তবসম্মত হয়তো নয়। কিন্তু তত ক্ষণে সেই ট্রাকের বন্দিনীর মতোই মনে হচ্ছে, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়!’ চারপাশে ভালমন্দ, বিচিত্র সংস্কৃতি, মানুষের রং! অজানা হাইওয়েয় বিপদ আছে ঠিকই! কিন্তু বাড়ির অন্দরমহলে কি নেই! যেতে যেতে তা বুঝতে পারে মেয়েটি। ছোটবেলায় পরম নির্ভরতার স্নেহশীল গুরুজনের হাতে যৌন হেনস্থার স্মৃতি খুঁচিয়ে প্রথম বার তার মধ্যে প্রতিবাদের সঙ্কল্প ফুঁসে ওঠে।

না-প্রেম, না-বন্ধুত্ব, না-বাৎসল্য আবার সব কিছুর মিশেলেই যেন এক নামহীন সম্পর্ককে আবিষ্কারের মনোভূমিও এই দেশ। যেখানে দুজনে দুজনকে অসংকোচে আঁকড়ে ঘুমিয়ে পড়া যায়। হিমশীতল এক অপরাধীর মধ্যেই এই মানুষটিকে খুঁজে পায় অপহৃত তরুণী। সে আর ফিরতে চায় না। বস্তাবন্দি করে বাড়ি থেকে বহু দূরে ফেলে আসা বেড়ালছানার মতোই নাছোড় ভঙ্গিতে অপহরণকারীর হাত ধরে থাকে। ওরা কোথাও পৌঁছতে চায় না। শুধু এক সঙ্গে চলতে চায়। পোড়খাওয়া অপরাধীও ভুলে যায়, ঘাড়ের কাছে খ্যাপা কুকুরের মতো পুলিশ-গোয়েন্দার নিশ্বাস!

প্রত্যাশামাফিক কঠিন-মেদুর নিসর্গের রোম্যান্সও হাত মিলিয়েছে এই অন্য দেশের নির্মাণে। তাই পাহাড়ি রাস্তায় বাসের ছাদে হাওয়ার জলছিটে বা বরফমোড়া পাহাড়ের হাতছানিতে ভেসে চলা। অজানা প্রাসাদের খণ্ডহর কি পাহাড়ি কুটিরে রাত্রিযাপন। এ-দেশ দ্বীপের মতো পারিবারিক ড্রয়িংরুমের সীমানায় আটকে নেই। এখানে, নিজের বাড়ির চাবি হাসতে হাসতে দু’দিনের অতিথির হাতে তুলে দেওয়া যায়! হেথায় নিষেধ নাইরে দাদা, নাইকো বাঁধন, নাইকো বাধা!

আবার এখানেই পিকচার পোস্টকার্ড নিসর্গ খানখান করে অশ্লীল ভাবে গর্জে ওঠে গুলির শব্দ। বন্দুকবাজ রাষ্ট্র সচরাচর এই অন্য দেশের মনের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করে না।

লোকসভা ভোটের দামামার মধ্যে সমান্তরাল এই দেশটা এখন গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন। রাষ্ট্রের উন্নয়নের হাইওয়েয় তাকে শামিল করতেই চলছে-চলবে সেনাবাহিনীর রুটমার্চ থেকে অতিমানব নেতা-নেত্রীদের মরসুমি সংলাপের ফুলঝুরি। বলিউডও বরাবর এই দুই দেশকে মেলানোর চেষ্টা করে এসেছে। দীর্ঘ সড়কপথে সেনা, পুলিশ, থানা, চেকপোস্ট, টহলদারি থেকে পরিবারের টান--- সবই এই আয়োজনের উপাদান। সেলুলয়েডের হাইওয়ে এ সব নিয়েই সেই পুরনো ছক ভাঙার চেষ্টা করে গেল। অপহৃত এক তরুণী ও তার অপহরণকারীর হাত ধরে পেরিয়ে গেল পরিবার-সর্বস্বতা কিংবা সনাতন ভারতীয় সংস্কারের চেকপোস্ট। এটা দেখতে দেখতেই কয়েক যুগ আগের নানান ছবির পারিবারিক দুর্যোগ নিয়ে অস্বস্তির দৃশ্যাবলি মনে পড়ছিল।

আজকের এই ভারত-পরিক্রমা কোনও ক্ষুদ্র জাতীয়তাবোধের ধার ধারে না। এক নির্ভার সাতরঙা দেশেই পৌঁছে দিতে চায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

riju basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE