শিরোনামটি অনন্ত সিংহের আত্মজীবনীর নাম থেকে নেওয়া। কেবল একটা শব্দ বদলে দিয়েছি। ছিল ডাকাত, করেছি সন্ত্রাসবাদী। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে সূর্য সেনের সহযোগী অনন্ত সিংহ। অনন্ত ও তাঁর অন্যান্য সহযোদ্ধা পরে আত্মজীবনী লেখেন। ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন বা তাঁর সঙ্গীদের চৌহদ্দির মধ্যে সন্ত্রাসবাদী শব্দটি আসতে দেওয়া যায় কি না ভাবতে গিয়ে এই সব আত্মজীবনীর কথাই মনে পড়ল।
ক্ষুদিরামদের সন্ত্রাসবাদী বলায় যাঁদের আপত্তি, তাঁদের যুক্তি মূলত দুটি। এক, ২০০১ সালের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংসের পর থেকে সাধারণ অর্থে ‘সন্ত্রাসবাদী’ শব্দটির যে ভয়ানক দ্যোতনা, তার মূল কথা হল, নির্বিচার নৃশংস গণহত্যার ঠিকাদার। একটি বিশেষ ধরনের সন্ত্রাসে বিশ্বাসী এই চরিত্ররা নিষ্ঠুর, নির্মম, আবেগবর্জিত মৃত্যুর কারবারি। এদের একমাত্র লক্ষ্য, সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মানুষ মারা এবং বিরোধী পক্ষকে ধ্বংসের ভয় দেখিয়ে নতজানু করা।
যেমন, ধরা যাক ওসামা বিন লাদেন বা আজমল কসাব। এক শিশুসাহিত্যিক তথা ছায়াচিত্র-নির্মাতা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদী’ শব্দটা শুনলেই তাঁর চোখের সামনে ওই ছত্রপতি শিবাজি রেল স্টেশনে গণহত্যারত কসাবের ছবিটা ভেসে ওঠে আর শরীর-মন রাগে ঘৃণায় কাঁপতে থাকে। অর্থাৎ যে শব্দ এই মৃত্যু-ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে, তাকে দিয়ে ক্ষুদিরামদের বর্ণনা করার অর্থ তাঁদের স্বার্থত্যাগের অপমান বা অপলাপ। তরলমতি কিশোর-কিশোরীদের ভুল ইতিহাস শেখানো।
ঠিক কথা, স্কুলপাঠ্য বইগুলো ইতিহাসের ব্যবহারিক রূপের সবচেয়ে বড় ধারক ও বাহক। বহু লক্ষ তেরো বছর বয়সি ছাত্রছাত্রী এই সরকারি বইটি পড়বে। এদের সিংহভাগই হয়তো আর দু’বছর বাদে কখনও নিয়মিত ইতিহাস পড়বে না। অর্থাৎ, বাঙালি সমাজের জনসাধারণের ইতিহাসবোধ-গণস্মৃতির বাঞ্ছনীয় বিন্যাস তৈরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে এই স্কুলপাঠ্য বইগুলির। এই প্রেক্ষিতে এই শব্দটির এমন অবাঞ্ছিত ব্যবহার মেনে নেওয়া যায় কি?
এক নম্বর যুক্তিটার কেন্দ্রবিন্দুতে যদি থাকেন ক্ষুদিরাম কিংবা সূর্য সেন, দু’নম্বর যুক্তির ভরকেন্দ্র হল অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা, বয়স যাদের তেরো থেকে চোদ্দো। আপত্তিকারীদের মতে, সন্ত্রাসবাদী শব্দটির প্রেক্ষিত-সাপেক্ষ বিভিন্ন অর্থের সূক্ষ্ম পার্থক্য বোঝার মতো মানসিক পরিণতি এদের থাকতে পারে না। খেয়াল করা দরকার, এখানে তাঁরা পক্ষান্তরে মেনে নিচ্ছেন যে, ইতিহাসবিদরা সন্ত্রাসবাদী বললেই ক্ষুদিরাম মোটেই বিন লাদেন হয়ে যান না। কিন্তু সেই কথাটা বোঝার ক্ষমতা সাড়ে তেরো বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের থাকতে পারে, এটা তাঁরা মানতে রাজি নন।
এই দুটো যুক্তিকে তিনটে হ্যাঁ/না প্রশ্নে অনুবাদ করা যায়। এক, বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী বলে ক্ষুদিরামদের ইচ্ছে করে অপমান করা হয়েছে না হয়নি? দুই, ক্ষুদিরামদের কি আচমকা নতুন করে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী বলা শুরু হল? তিন, সাড়ে তেরো বছরের ছেলেমেয়েরা বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী এবং আজকের গণহত্যার কারবারিদের পার্থক্য বুঝবে, না বুঝবে না?
উত্তর হল, না, না এবং হ্যাঁ। প্রথম দুটো প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গেই দেওয়া যায়। মনে রাখা দরকার, পাঠ্যবইতে ক্ষুদিরাম বা তাঁর সতীর্থদের সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত করা হয়নি। যে শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি হল ‘বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী’। শব্দ দুটির অর্থ এক নয়। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে, সন্ত্রাসবাদ মানে কেবল বিন লাদেন, আজমল কসাবদের আদর্শ, বিশ্বাস এবং কাজকর্ম, অর্থাৎ ঠান্ডা মাথায় নির্বিচারে গণহত্যা, তা হলেও কিন্তু কোনও ভাবেই বলা যায় না যে পাঠ্যপুস্তকটিতে ক্ষুদিরাম এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার গুঁড়িয়ে দেওয়া বা তাজমহল হোটেলে নৃশংস আক্রম চালানো হত্যাব্যবসায়ীদের একাসনে বসানো হয়েছে। সন্ত্রাসবাদী এবং বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী দুটো শব্দের অর্থকে যাঁরা আলাদা করে দেখতে পারছেন না, তাঁদের ইতিহাস এবং বাংলা ভাষা দুটোই ফিরে পড়তে হবে। প্রয়োজন একটা সুস্থ এবং যুক্তিতথ্যনিষ্ঠ বিতর্ক। গণমাধ্যমের আংশিক উদ্ধৃতির ক্ষণিক উত্তেজনা যার মঞ্চ কিংবা মালমশলা কোনওটাই হতে পারে না।
বহু বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী পরে স্মৃতিকথা লিখেছেন। প্রায় প্রত্যেকেই অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে নিজেদের বিপ্লবী এবং সন্ত্রাসবাদী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেকে নিজেদের অতীতকে সমালোচনা করেছেন কড়া ভাষায়, যেমন, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ। আবার অনেকে খানিকটা নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন সেই সময়কে, যেমন হেমচন্দ্র কানুনগো, যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় বা অনন্ত সিংহ। কিন্তু কেউই নিজেদের পথের নামকরণ নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগেননি। সুতরাং বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী শব্দটি কেবল ঔপনিবেশিক শাসকদের বিশ্লেষণী বর্গবিন্যাসের গা-জোয়ারি না।
ক্ষুদিরাম থেকে শুরু করে ভগত সিং পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গুপ্তসংগ্রামে বিশ্বাসী স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের অন্তত গত চার দশক ধরে ইতিহাসের গবেষক, অধ্যাপক তথা ছাত্রছাত্রীরা বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী বলে আসছেন। কোন কোন ইতিহাসবিদের বইতে শব্দটি রয়েছে, তার হিসেব দিতে হলে পাতা ভরে যাবে। সুমিত সরকার, রজতকান্ত রায়, সুগত বসু, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, সকলেই লিখেছেন। গৌতম ভদ্রও বলেছেন যে, এঁদের কাজকর্মের সঙ্গে আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীদের অনুরণন মেলে, খানিকটা সেই কারণেই এই নামকরণ। উনি এ-ও বলেন যে, স্বাধীনচেতা আইরিশদের কিন্তু আজ শব্দবন্ধটি নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। এমনকী অমলেশ ত্রিপাঠীর মতো জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদ পর্যন্ত ক্ষুদিরাম তথা ‘অরবিন্দের দল’-এর কার্যকলাপ বর্ণনা করতে গিয়ে নির্দ্বিধায় ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ইতিহাস গবেষক এবং পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিয়কুমার সামন্ত নব্বইয়ের দশকে বাংলায় সহিংস স্বাধীনতা আন্দোলন বিষয়ে পাঁচ খণ্ডের যে প্রামাণ্য বই প্রকাশ করেছেন, তারও নাম ‘টেররিজ্ম ইন বেঙ্গল’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সেই সংকলনের প্রকাশক হলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এ ছাড়া একগুচ্ছ পাঠ্যপুস্তক লেখকও তাঁদের বইতে ক্ষুদিরামদের বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী বলেই বর্ণনা করেছেন। আরও আশ্চর্যের কথা হল, এখন আপত্তি করছেন, এমন এক ইতিহাসবিদও ২০০৮ সালে প্রকাশিত তাঁর নিজের একটি রচনায় ক্ষুদিরামদের চিন্তা তথা কার্যধারাকে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ বলতে দ্বিধা করেননি। ২০০৮ সময়টা উল্লেখ করা জরুরি, কেন না ২০০১ সালের সাত বছর পরেও ক্ষুদিরামদের বর্ণনা করতে গিয়ে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী শব্দবন্ধটি ব্যবহারে কোনও ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা দেখেননি এই অধ্যাপক-ইতিহাসবিদ।
তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীরা নিজেরা এবং দেশ-বিদেশে স্বীকৃত বহু বাঙালি এবং অবাঙালি ইতিহাসবিদ, পাঠ্যপুস্তক লেখকরা এমনকী আজকের অন্যতম প্রতিবাদী ইতিহাসবিদও দীর্ঘ দিন ধরে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী শব্দবন্ধটি ব্যবহার করে এসেছেন। এ ক্ষেত্রে ইচ্ছে করে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অমর্যাদার প্রশ্ন আসতেই পারে না। তবে, এ কথা মানতেই হবে যে, বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীদের আসল লক্ষ্য রাজপুরুষরা হলেও তাঁদের হাতে মৃত বা আহত অনেকেই আদৌ ঔপনিবেশিক শাসন তথা শোষণযন্ত্রের সঙ্গে সক্রিয় অংশ ছিলেন না। ‘আমাদের’ স্বাধীনতা সত্যিই কি ‘তাঁদের’ প্রাণের যথেষ্ট মূল্য? ইতিহাস রচনা এবং পাঠ কি তা হলে অতীতের নামকরণ বা বর্গীকরণের দর কষাকষির একটা মঞ্চ মাত্র? প্রশ্নটা কঠিন। আপাতত তুলে রাখলাম।
আর দুটো কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের তত্ত্বাবধানে এই প্রথম বাংলায় স্কুল পাঠ্যপুস্তক লেখার একটা ইতিবাচক প্রকল্প শুরু হয়েছে। প্রকল্পটি সফল না হলে ঠিক কাদের লাভ হতে পারে, সেটা অনুমান করে নেওয়া হয়তো কঠিন নয়। দুই, যে পাঁচ জন ইতিহাসবিদকে সরকার এই বিতর্কের সমাধান করতে আহ্বান করেছে, তাঁদের কি আর একটু দীর্ঘমেয়াদি ভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে স্কুলপাঠ্য বই লেখার এই প্রকল্পে উপদেষ্টা হিসেবে আসতে অনুরোধ করা যায় না? স্কুল শিক্ষকদের যদি মাঝে মাঝে বরিষ্ঠ ইতিহাসবিদদের কাছে ক্লাস করতে হয়, তাতে ভাল বই মন্দ কি?
এ বারে আসি সাড়ে তেরোর কথায়। শিক্ষা-মনোবিদরা নিশ্চিত যে, ঠিক ভাবে বোঝালে তারা জটিল চিন্তাধারা খুব বুঝতে পারে। তারা দূরদর্শনে, অন্তরজালে সারা পৃথিবীর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চলেছে। তারা হাল ফ্যাশনের সাজগোজ বোঝে, দুর্নীতি বোঝে, রাজনীতি বোঝে। আর স্কুলে ঠিকমত পড়ানো হলে ক্ষুদিরাম আর কাসভের তফাত বুঝবে না? ওদের অপরিণত শিশু মনে করা কেবল ওদের না, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকিদেরও অপমান। যাঁরা ক্ষুদিরামের জীবনী পড়েছেন, তাঁরা জানেন যে, উনি এবং আরও শত শত অগ্নিযুবক মোটামুটি এই রকম বয়সেই বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী কর্মযজ্ঞে শামিল হন। সমস্যাটা আসলে তেরো বছরের কিশোরকিশোরীদের না, আমাদের। যদি পশ্চিমবঙ্গের স্কুলের ইতিহাস শিক্ষকরা বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী ধারণাটির ঠিক অর্থ ক্লাসে বোঝাতে না পারেন, তা হলে খামতিটা ছাত্রদের, না তাঁদের?
ইতিহাস গবেষক, এডুকেশন মাল্টিমিডিয়া রিসার্চ সেন্টার-এ কর্মরত