Advertisement
০২ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২...

কতটা ঝুঁকি নিচ্ছেন, স্পষ্ট ভাবে জেনে নিন

কৃত্রিম গর্ভস্থাপনের বিভিন্ন প্রযুক্তি আমাদের নাগালে এসেছে। তার খরচ বিপুল, ঝুঁকিও। যে সব সন্তানহীন মহিলা মাতৃত্বের বাসনা নিয়ে এই চিকিৎসার দ্বারস্থ হচ্ছেন, তাঁদের কাছে এই ঝুঁকির কথা খুলে বলা প্রয়োজন। সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়আশা তেওয়ারির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, আসুন। ছত্রিশ বছর বয়স। হাসপাতালের কেবিনে আপাতত ঘুমিয়ে আছেন তিনি। তাঁর দু’নম্বর কেমো চলছে। ওঁর স্বামী, আনন্দ, ওঁদের দত্তক নেওয়া দেড় বছরের মেয়ে সুনন্দাকে নিয়ে বাইরে ঘুরছেন। সাত মাস হল দত্তক নিয়েছেন আশারা।

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৪ ০৪:১৭
Share: Save:

আশা তেওয়ারির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, আসুন। ছত্রিশ বছর বয়স। হাসপাতালের কেবিনে আপাতত ঘুমিয়ে আছেন তিনি। তাঁর দু’নম্বর কেমো চলছে। ওঁর স্বামী, আনন্দ, ওঁদের দত্তক নেওয়া দেড় বছরের মেয়ে সুনন্দাকে নিয়ে বাইরে ঘুরছেন। সাত মাস হল দত্তক নিয়েছেন আশারা।

তার আগের তিন বছরের দুঃস্বপ্নের কথা আশা আর আনন্দ কি চাইলেও কখনও ভুলতে পারবেন? বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় একেবারে জেরবার হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ছোট-বড় অপারেশন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন বসে থাকা ডাক্তারের চেম্বারে, ক্লিনিকের অপেক্ষা ঘরে। এক ডাক্তার থেকে আর এক ডাক্তারের কাছে ছুটেছেন। কারও কাজে সাফল্যের খবর পেয়ে সেই ডাক্তারের কাছেই হাজির হয়েছেন, আবার নতুন আশায় বুক বেঁধে। কাঙ্ক্ষিত ফলটুকুই যা শুধু মেলেনি।

প্রথম প্রথম ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী দিন ও সময় ঠিক করে মিলিত হতেন তাঁরা। তার পর, সেই শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াটিও, চিকিৎসকের চোখে, অবান্তর হয়ে গেল। আশার শরীরে আরও বেশি ওষুধ প্রয়োগ করা আরম্ভ হল ঠিক সময়ে ডিম্বাণু নিঃসরণের জন্য। আশা আর আনন্দ স্বাভাবিক ভাবে মিলিত হওয়া বন্ধই করে দিলেন। অহেতুক বীর্যপাত ঘটিয়ে নাকি শুক্রাণুর সংখ্যা ও শক্তি কমিয়ে লাভ নেই!

প্রথমে কিছু দিন ইন্ট্রা ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন, সংক্ষেপে আই ইউ আই (অর্থাৎ, জরায়ুর মধ্যে প্রতিস্থাপন)-এর মাধ্যমে চেষ্টা করার পর যখন সাফল্য এল না, তখন শুরু হল আই ভি এফ বা ‘টেস্ট টিউব’ সন্তানের পরিকল্পনা। আরও দামি-দামি ইঞ্জেকশন নেওয়া। আরও খরচা প্রথম বার ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় বার, তাতেও না হলে তৃতীয় বার... আরও খরচ। সাধ্যাতীত খরচ। ক্লিনিক পরিসংখ্যান দেখিয়ে চলেছে। চার বারের বার নাকি অবধারিত সাফল্য! পত্রপত্রিকার বিজ্ঞাপনেও তেমন কথাই চোখে পড়ত আশার। ইচ্ছে করলেই এখন যে কেউ মা হতে পারেন। বয়স কোনও ব্যাপার নয়। নিজের পুরুষ মানুষ সঙ্গী না থাকলেও চলবে। নিজে ন’মাস গর্ভধারণে অপারগ বা অনিচ্ছুক হলে গর্ভ ভাড়াও নেওয়া চলে। কিছু দিন আগেই একটা খবর চোখে পড়েছিল আশার, ৫৬ বছর বয়সি এক মহিলা এক নলজাতকের মা হয়েছেন। আশার বিভ্রান্ত লাগত তবে কেন তিনিই মা হতে পারলেন না? আরও এক বার চেষ্টা করে দেখবেন কি? আবারও?

আশার মতো যে মহিলারা সন্তানের প্রত্যাশায় এক ক্নিনিক থেকে আর এক ক্লিনিকে দৌড়ে বেড়ান, এক বার হতাশ হওয়ার পর আরও এক বার বুক বাঁধেন, অনেকগুলো সত্যি কথা বহু দিন পর্যন্ত তাঁদের অজানা থেকে যায়। বিজ্ঞাপন হোক বা সংবাদ, প্রতি ক্ষেত্রেই সাফল্যের গল্পগুলোই আমাদের কাছে পৌঁছয়, ব্যর্থরা অন্ধকারেই থেকে যান। নলজাতকের আশায় চিকিৎসা শুরু করিয়েছেন, এমন প্রতি ১০০ মহিলার মধ্যে কত জন শেষ পর্যন্ত মা হতে পারেন? অর্ধেক মহিলার ক্ষেত্রে আই ভি এফ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। বাকি ৫০ জনের ক্ষেত্রে কেমিকাল প্রেগন্যান্সি পাওয়া যায়, অর্থাৎ মূত্র পরীক্ষায় তাঁদের গর্ভধারণের প্রমাণ মেলে। কিন্তু তার পরের ধাপের পরীক্ষা, অর্থাৎ আলট্রাসোনোগ্রাফিতে দেখা যায়, অন্তত ১০ জনের ক্ষেত্রে গর্ভধারণের সেই প্রমাণটি ভুল ছিল। মানে, পড়ে থাকলেন ৪০ জন। তাঁদের মধ্যে আরও দশ জন বাদ পড়ে যান ক্লিনিকাল টেস্টের সময়। যে ৩০ জনের গর্ভে সত্যিই সন্তান আসে, তাঁদের মধ্যেও ১০ জন শেষ পর্যন্ত মা হতে পারেন না আইভিএফ-এ গর্ভপাতের হার বেশ চড়া। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ জন মহিলার মধ্যে সন্তান কোলে বাড়ি যেতে পারেন মাত্র ২০ জন। শুধু কলকাতা বা ভারতে নয়, দুনিয়ার সেরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে এটাই সাফল্যের হার। স্বাভাবিক গর্ভধারণের ক্ষেত্রে এই হার ৮০ শতাংশেরও বেশি। অনেকেই অবাক হবেন হয়তো নলজাতকের বিজ্ঞাপনে তো ঢের বেশি সাফল্যের কথা বলা হয়। বেশির ভাগ বিজ্ঞাপনেই আসলে কেমিকাল প্রেগন্যান্সির হারের কথা বলে মূত্র পরীক্ষার পর যত জনের গর্ভে সন্তানের ইঙ্গিত মেলে, তত জনের কথা। কিন্তু, সে হিসেবে কী লাভ?

আশা তেওয়ারির মতো মহিলারা ‘ব্যর্থ’ ৮০ জনের দলে। এই ব্যর্থতা কিন্তু তাঁরা বহু মূল্যে অর্জন করেন। দিনের পর দিন ক্লিনিকে যাওয়া, অপেক্ষা করা, ইঞ্জেকশন নেওয়া, সোনোগ্রাফি করে দেখা শারীরিক ও মানসিক ধকল কম নয়। কিন্তু, সেখানেই যে শেষ নয়, হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে থাকা আশা বিলক্ষণ জানেন। কৃত্রিম গর্ভধারণের চেষ্টা তাঁর শরীরে ক্যান্সারের বাসা গড়ে দিয়েছে। মাসের একটি পূর্বনির্ধারিত তারিখে যাতে ডিম্বাণু নিঃসৃত হয়, তার জন্য একের পর এক হরমোন ইঞ্জেকশন নিতে হয় আশাদের। এই হরমোন যে কার্সিনোজেনিক হতে পারে, তার বহু প্রমাণ মিলছে। যে সমস্ত মহিলা এই চিকিৎসা করিয়েছেন দীর্ঘ দিন, তাঁদের প্রত্যেকেরই দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য-পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। ডিম্বাশয়ে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা এঁদের প্রায় দ্বিগুণ। সময়ের আগেই মেনোপজ আসার সম্ভাবনাও অনেক বেশি।

যে কোনও প্রযুক্তিরই কিছু নেতিবাচক, ক্ষতিকর দিক থাকতে পারে। যে প্রযুক্তি অতি মূল্যবান, তারও। শুধুমাত্র ক্ষতিকর দিকগুলোর কারণেই কৃত্রিম গর্ভধারণের বিভিন্ন প্রযুক্তিকে বাতিল করে দিতে হবে, এমন কোনও দাবি করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু, যে মহিলারা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মা হতে আসছেন, তাঁদের কাছে এর ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পূর্ণ খুলে না বলা অনৈতিক। এই প্রযুক্তিতে মা হতে পারার প্রকৃত সম্ভাবনা কত, এবং তাতে কী কী ঝুঁকি আছে, গোড়াতেই সবটুকু খুলে বলা দরকার। সেই লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করার স্বাধীনতাটুকু প্রত্যেকের থাকা উচিত। পরিষেবাটির ক্রেতা হিসেবেই।

আশা বহু চেষ্টার পর সুনন্দাকে দত্তক নিয়ে মা হয়েছেন। মাতৃত্বের এটাও তো পথ। এই কথাটাও কি মা হতে চাওয়া মহিলাদের ভাল করে বুঝিয়ে বলা যায় না?

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ।

(সব নাম পরিবর্তিত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE