Advertisement
১৭ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

কর ছাড় রদ করা সব দিক দিয়ে ভাল

প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ, দু’ধরনের করের ক্ষেত্রেই ছাড় রদ করা উচিত। এই ছাড়গুলির জন্য রাজস্বের বিরাট ক্ষতি হয়। তা ছাড়া, কর ছাড়ের গোটা ব্যবস্থাটাই খুব অযৌক্তিক, মর্জিনির্ভর এবং অস্বচ্ছ। এবং সমতার পরিপন্থী।অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির বাজেটে কর ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, কিন্তু এ বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে না এবং যে আলোচনা হচ্ছে সেটাও অনেক সময়েই স্পষ্ট ও তথ্যনিষ্ঠ নয়। তাঁর করপ্রস্তাব সম্বন্ধে কয়েকটা কথা বলা দরকার। এই আলোচনার প্রেক্ষাপট হিসেবে বলে রাখা ভাল যে, ভারতে মোট কর আদায় এবং জিডিপি’র অনুপাত এখন ১০.৩ শতাংশ।

বিবেক দেবরায়
শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির বাজেটে কর ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, কিন্তু এ বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে না এবং যে আলোচনা হচ্ছে সেটাও অনেক সময়েই স্পষ্ট ও তথ্যনিষ্ঠ নয়। তাঁর করপ্রস্তাব সম্বন্ধে কয়েকটা কথা বলা দরকার। এই আলোচনার প্রেক্ষাপট হিসেবে বলে রাখা ভাল যে, ভারতে মোট কর আদায় এবং জিডিপি’র অনুপাত এখন ১০.৩ শতাংশ। বছর বছর এই অনুপাত কিছুটা ওঠানামা করে। খুব ভাল হলে ১১ শতাংশ অবধি ওঠে, তার বেশি নয়। এটা কেন্দ্রীয় করের হিসেব, রাজ্যের কর আদায় যোগ করলে ১৮ শতাংশ অবধি পৌঁছয়। আপাতত কেন্দ্রীয় করের কথাতেই থাকা যাক।

কেন্দ্রের হোক বা রাজ্যের, কর দু’ধরনের: প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ। ব্যক্তিগত বা কোম্পানি আয়কর হল প্রত্যক্ষ। এগুলি মেটায় ব্যক্তি বা সংস্থা। পরোক্ষ কর হল পণ্য বা পরিষেবার সঙ্গে সম্পর্কিত। কর ব্যবস্থার একটা লক্ষ্য হল সমতা। সম্পন্ন নাগরিকদের আয়ের উপর তুলনায় বেশি হারে কর বসিয়ে এই লক্ষ্য পূরণ করা হয়। এই ‘প্রগ্রেসিভ’ বা প্রগতিশীল করের নীতি প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা তুলনায় সহজ। পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে এটা কিছুটা সম্ভব, যেমন তথাকথিত বিলাসদ্রব্যের উপর চড়া কর বসিয়ে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কোন জিনিসটা বড়লোকের ভোগ্য আর কোনটা গরিবের, সেই বাছবিচার করে কর বসানো খুব কঠিন। তাই করের হার নির্ধারণ করতে গিয়ে পণ্য এবং পরিষেবার সূক্ষ্মবিচার না করে একটা সাধারণ হারে কর বসানোই বিবেচনার কাজ। তাতে কর ব্যবস্থার সরলীকরণ হতে পারে, কর আদায়ের ব্যয়ও কমে। এবং এটা ধরে নেওয়াই ভাল যে পরোক্ষ কর দিয়ে সমতা আনা কঠিন, ওটা সব বর্গের মানুষের উপরেই এক ভাবে প্রযোজ্য হবে। সমতা বাড়াতে চাইলে পরোক্ষ করের তুলনায় প্রত্যক্ষ করের গুরুত্ব বাড়ানো দরকার।

ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার যত টাকা কর আদায় করে, তার ৫৪ শতাংশ আসে প্রত্যক্ষ কর থেকে, বাকিটা পরোক্ষ কর বাবদ। কিন্তু রাজ্য স্তরে প্রত্যক্ষ করের অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ, ৮৬ শতাংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে। প্রত্যক্ষ কর যদি সমতার বিচারে শ্রেয় হয়, তা হলে রাজ্যগুলি তাকে এত কম গুরুত্ব দেয় কেন? একটা কারণ হল, ভারতীয় সংবিধান অনুসারে কৃষি-আয়ের উপর কর বসাতে পারে রাজ্য সরকার, কিন্তু কৃষকদের কাছে কর আদায়ে তাদের প্রবল অনীহা। আর একটা কারণ হল নানা রকম কর ছাড়ের বন্দোবস্ত, যে প্রসঙ্গে পরে ফিরে আসব। সেই তুলনায় পরোক্ষ কর বসানো ও আদায় করা অনেক সহজ।

কিন্তু কালক্রমে আমরা পরোক্ষ করের কাঠামোটাকে খুব জটিল করে তুলেছি। অর্থনীতিতে পরিষেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই গুরুত্ব ক্রমশই বাড়ছে, অথচ পরোক্ষ করের কাঠামোয় এখনও পরিষেবা যথেষ্ট সুগ্রথিত হয়নি। এই সমস্যার সমাধান করতেই পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে সারা দেশের জন্য পণ্য ও পরিষেবা কর (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) বা ‘জিএসটি’ নামক একটি অভিন্ন কাঠামো প্রবর্তনের উদ্যোগ চলছে। আদর্শ অবস্থায়, সব পণ্য এবং পরিষেবার উপর একই হারে জিএসটি ধার্য হওয়া উচিত, কোনও ব্যতিক্রম বা ছাড় থাকা ঠিক নয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ততটা হবে না, অন্তত প্রথমে। প্রথমত, স্ট্যাম্প ডিউটি এবং এনট্রি ট্যাক্স বা পণ্য প্রবেশ কর সম্ভবত জিএসটি-র বাইরে থাকবে। দ্বিতীয়ত, মদ, তামাক এবং পেট্রোলিয়মজাত পণ্যের জন্য আলাদা কর-কাঠামো থাকবে। তৃতীয়ত, জিএসটি-র মূল বা সাধারণীকৃত হার থেকে রাজ্যগুলি কিছুটা বিচ্যুতির সুযোগ দেওয়া হবে। চতুর্থত, পরিষেবার একটা ‘নেগেটিভ লিস্ট’ বা না-সূচক তালিকা থাকবে, যেগুলির উপর এই কর বসানো হবে না। অর্থাৎ আপাতত জিএসটি চালু হলেও সেটি আদর্শ জিএসটি হবে না।

জিএসটি-র হার কত হলে রাজস্ব আদায়ের মাত্রা একই থাকবে? অন্য ভাবে বললে, রাজস্ব-নিরপেক্ষ জিএসটি’র হার কত? আমরা জানি না। কীসে কতটা ছাড় দেওয়া হচ্ছে, তার উপর এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে। ছাড়ের মাত্রা যত বেশি, রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ধরে রাখতে তত বেশি হারে জিএসটি বসাতে হবে। জিএসটি কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুসারে কেন্দ্র ও রাজ্য মিলে জিএসটি’র হার স্থির করবে। এই হার হবে ১৬ থেকে ২২ শতাংশের মধ্যে। ধরে নেওয়া যাক, হারটি হবে ১৬ শতাংশ, যদিও আমার ধারণা হারটা এর চেয়ে বেশি হবে। এখন অনেক পণ্যের উপর এর চেয়ে বেশি হারে পরোক্ষ কর বসানো আছে, সুতরাং জিএসটি চালু হলে সেগুলির উপর কর কমবে। আবার অনেক পরিষেবার উপর করের হার এর চেয়ে কম, সেগুলির উপর কর বাড়বে। বাজেটে পরিষেবা কর বাড়িয়ে ১৪ শতাংশ করা হয়েছে বলে অযথা শোরগোল হচ্ছে। আমাদের তো একটা সরল এবং অভিন্ন কর-কাঠামোর দিকে যেতে হবে।

এ বার আসি প্রত্যক্ষ করের প্রসঙ্গে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার ৯৭ নম্বর অনুচ্ছেদটি নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কর্পোরেট ট্যাক্স বা কোম্পানি আয়কর ৩০ থেকে ২৫ শতাংশে কমানো হচ্ছে, এই কথাটা ঠিক নয়। অনুচ্ছেদটি ভাল করে পড়া দরকার। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কোম্পানি আয়করের হার ৩০ শতাংশ হলেও নানা ধরনের ছাড়ের ফলে কার্যক্ষেত্রে এই কর আদায়ের হার মোটামুটি ২৩ শতাংশ। তাঁর প্রস্তাব, এক দিকে করের হার চার বছরে ২৫ শতাংশে নামানো হবে, অন্য দিকে বিভিন্ন ছাড় ক্রমশ তুলে নেওয়া হবে। ছাড়ের ব্যাপারটা একটু বিশদ ভাবে বলা দরকার। বাজেটের নথিপত্রের মধ্যে একটি নথি থাকে: কেন্দ্রীয় কর ব্যবস্থায় করের ক্ষেত্রে উৎসাহ দেওয়ার ফলে রাজস্বের উপর কী প্রভাব পড়ে তার বিবৃতি। এটা আর কিছুই নয়, বিভিন্ন কর ছাড়ের ফলে রাজস্বের কতটা ক্ষতি হয় তার হিসেব। ২০১৪-১৫’য় ক্ষতির পরিমাণ ছিল এই রকম: কোম্পানি আয়কর ছাড়ের ফলে ৬২,৩৯৯ কোটি টাকা, কর্পোরেট দুনিয়ার বাইরে শিল্পবাণিজ্য সংস্থাকে প্রদত্ত ছাড়ের ফলে ৫,১৪১ কোটি টাকা, ব্যক্তিগত আয়কর ছাড় বাবদ ৩৫,২৯৪ কোটি টাকা, উৎপাদন শুল্প ছাড় বাবদ ১৮৪,৭৬৪ কোটি টাকা এবং আমদানি শুল্ক ছাড়ের ফলে ক্ষতির অঙ্ক ৩০১,৬৮৮ কোটি টাকা। যোগ করে দেখতে পারেন। এই ছাড়গুলি যদি রদ করা যায়, ভারতে কর এবং জিডিপি’র অনুপাত অনায়াসে ২৩ শতাংশ অবধি বাড়তে পারে।

তা ছাড়া, কর ছাড়ের গোটা ব্যবস্থাটাই খুব অযৌক্তিক, মর্জিনির্ভর এবং অস্বচ্ছ, ফলে এই নিয়ে বিস্তর মামলা মোকদ্দমা হয়ে থাকে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ, দু’ধরনের করের ক্ষেত্রেই ছাড় রদ করা উচিত। এবং সব ছাড় তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি কোম্পানি আয়কর ২৫ শতাংশে নামানো হয়, তা হলে সেটা প্রগতিশীল পদক্ষেপ বলেই স্বীকৃত হবে, কারণ কার্যক্ষেত্রে কর আদায়ের অনুপাত এখনকার ২৩ শতাংশ থেকে বাড়বে। ব্যক্তিগত আয়করের ক্ষেত্রেও অনুরূপ সংস্কার দরকার।

শেষে ‘ওয়েল্থ ট্যাক্স’ বা সম্পদ কর সম্পর্কে একটা কথা বলা দরকার। এ বারের বাজেটে বলা হয়েছে, এই কর তুলে দিয়ে অতি-সম্পন্নদের আয়ের উপর ২ শতাংশ সারচার্জ বা অতিশুল্ক বসানো হচ্ছে, কারণ সম্পদ কর থেকে খুব কম রাজস্ব আদায় হয়। আমি মনে করি, কেবল পরিমাণ কম বলে নয়, সম্পদ কর নিয়ে নীতিগত প্রশ্নও আছে। সমস্ত প্রত্যক্ষ কর আদর্শ অবস্থায় আয়ের উপর বসানো উচিত। যা আয় নয়, তার উপর কর থাকা উচিত নয়। সম্পদ থেকে আয় হলে সেই আয়ের উপর কর ধার্য করা যায়। কিন্তু সম্পদ হল অতীতে অর্জিত সম্পদের সমষ্টি, সেই আয়ের উপর তো কর নেওয়া হয়েছে, তা হলে আবার সম্পদের জন্য কর দিতে হবে কেন? এটা তো দু’বার করে কর নেওয়ার শামিল। তাই সম্পদ কর তুলে দিয়ে অর্থমন্ত্রী নীতিগত ভাবেও ঠিক কাজ করেছেন।

অর্থনীতিবিদ, নীতি আয়োগের সদস্য। মতামত ব্যক্তিগত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bibek debroy tax union budget
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE