খুচরো কথায় ভোটের বাজার ভরিয়া গিয়াছে। কিন্তু খুচরো কথা আর খুচরোর কথা এক নহে। দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকার অন্তত একটি ভাল কাজের চেষ্টা করিয়াছে। রিটেল বা খুচরো ব্যবসায়ে বহুজাতিক সংস্থাকে ছাড়পত্র দেওয়ার উদ্যোগ করিয়াছে, সে জন্য রীতিমত জোরদার সওয়াল করিয়াছে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি এই বিষয়ে বিপরীত অবস্থানে— খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি লগ্নি চলিবে না। এবং তাহার জেদ প্রায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরূপ। নরেন্দ্র মোদীর কণ্ঠে ভিন্ন সুরের সংকেত মিলিয়াছিল, কিন্তু তাহাও দ্রুত চাপা পড়িয়া যায়। দলের নির্বাচনী ইস্তাহারেও নেতিবাদই সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষিত। এবং সেই ঘোষণা ও অবস্থানের বিপরীত স্বর ভোটের বাজারে বিশেষ শোনা যায় নাই। কংগ্রেসের প্রচারকরাও এই প্রশ্নে বিজেপিকে আক্রমণ করিবার কোনও চেষ্টা করে নাই। বাণিজ্য মন্ত্রী আনন্দ শর্মা ইতস্তত খুচরো বাজারের বিশ্বায়নের পক্ষে সওয়াল করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তুমুল কোলাহলে সে সকল কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে।
অথচ খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি লগ্নির প্রশ্নটি অত্যন্ত বড় প্রশ্ন। ভারতে খুচরো বাজার এখনও বহুলাংশে অসংগঠিত। অল্প মূলধন, ক্ষুদ্র আয়তন এবং মান্ধাতা আমলের ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তিই এই বাজারের চরিত্রলক্ষণ। বিদেশি লগ্নি কেবল অর্থ সরবরাহ করিবে না, তাহার সহিত গাঁটছড়া বাঁধিয়া আসিবে উন্নত প্রযুক্তি, উন্নত পরিচালনা। বাজারের দক্ষতা বাড়িলে তাহার সুফল ভোগ করিবেন এক দিকে অগণিত উপভোক্তা, অন্য দিকে অগণিত কৃষিজীবী। কেবলমাত্র তরিতরকারি বা মাছমাংসের মতো পচনশীল খাদ্যসামগ্রীর অপচয় রোধ করিয়াই যে বিপুল সম্পদ বাঁচিবে তাহা দেশের অর্থনীতির পক্ষে বড় আশীর্বাদ। তাহা হইলে কেন খুচরো ব্যবসায় হইতে বিদেশি সংস্থাকে দূরে রাখিবার এই তাগিদ? ইহার পিছনে রহিয়াছে অংশত বিদেশি সম্পর্কে ভারতীয় সমাজের দুর্মর সংশয়, বহুলাংশে গোষ্ঠীস্বার্থ। খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি বড় পুঁজির প্রবেশ ঘটিলে বর্তমান ব্যবসায়ের কাঠামোটিতে আঘাত পড়িবে, স্থিতাবস্থা নড়িয়া গেলে অনেকের অন্তত সাময়িক অসুবিধা হইবে। বাধা আসিতেছে সেই গোষ্ঠী হইতেই।
ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থকমণ্ডলীতে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একটি প্রভাব আছে। অতীতে, যখন দল ছোট ছিল, ভৌগোলিক পরিধিতে সীমিত ছিল, তখন সেই প্রভাব ছিল সমধিক। এখন দল বড় হইয়াছে, তাহার রাজনৈতিক পরিসর প্রসারিত হইয়াছে, কিন্তু স্বার্থগোষ্ঠী সহজে আপন লাগাম ছাড়িতে চাহে না। গোষ্ঠীর ক্ষুদ্র স্বার্থ এবং দলের বৃহত্তর স্বার্থের এই বিরোধ রাজনীতিতে অতি পরিচিত ঘটনা। খুচরো ব্যবসায় হইতে রামমন্দির— বিজেপি নানা ক্ষেত্রেই এই বিরোধের সম্মুখীন হইতেছে। দল পুরানো গণ্ডি ছাড়িয়া বাহির হইবার চেষ্টা করিতেছে না, এমন কথা বলা যায় না, নরেন্দ্র মোদীর ‘উন্নয়নী ভাবমূর্তি’ রচনার প্রাণপণ চেষ্টা এই আত্ম-উত্তরণেরই উদ্যোগ। কিন্তু সেই উদ্যোগের গতি এবং তেজ এখনও যথেষ্ট নয়। দলকে গোষ্ঠীর বৃত্ত হইতে বৃহত্তর জনসমাজে গ্রহণীয় করিবার জন্য নরেন্দ্র মোদী এবং সম্প্রদায়কে গোষ্ঠীস্বার্থ ভাঙিতে হইবে। খুচরো ব্যবসায়ে বহুজাতিক সংস্থাকে বাধা না দিয়া তাহার প্রবেশের জন্য উৎসাহ দিতে হইবে। তাহাতে কেবল খুচরো ব্যবসায়ের উন্নতি নহে, একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সংস্কারমুখিতা বিনিয়োগের পক্ষে সুলক্ষণ বলিয়া গণ্য হইবে। তাহাতে দেশের লাভ। খুচরো নয়, বৃহৎ লাভ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy