কংগ্রেসের ইস্তাহারটিও কংগ্রেসের মতোই বহু সদিচ্ছাই প্রশ্নাতীত, কিন্তু সেই ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করিতে কী করা প্রয়োজন, তাহার কোনও হদিশ সেই নথিতে নাই। এই দফায় জিতিয়া আসিলে স্বাস্থ্য হইতে পেনশন, সামাজিক নিরাপত্তা হইতে কাজের মানবিক পরিস্থিতি ইত্যাদির তো বটেই, নাগরিকদের ব্যবসায়িক উদ্যোগের অধিকারও দেওয়া হইবে বলিয়া দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটি জানাইয়াছে। ‘ব্যবসায়িক উদ্যোগের অধিকার’ বস্তুটি কী, তাত্ত্বিক ভাবেও এমন অধিকার সম্ভব কি না, সেই উত্তর অবশ্যই ইস্তাহারে নাই। ভোটদাতারা প্রশ্ন করিতে পারেন, এত অধিকার লইয়া কী করিব? আগের দুই দফায় যত ‘অধিকার’ মিলিয়াছে, তাহার কত শতাংশ সত্যই মানুষের নিকট হাতেকলমে পৌঁছাইয়াছে? দরিদ্র মানুষের প্রতি দরদ থাকা ভাল, কিন্তু সেই দরদকে কাজে পরিণত করিবার জন্য যে আর্থিক জোর প্রয়োজন হয়, কংগ্রেস তাহার কথা ভাবিয়া দেখিয়াছে কি?
শুধু অধিকারের প্রশ্নেই নহে, কংগ্রেসের ইস্তাহারে আর্থিক পরিকল্পনার অভাব সর্বত্র। ইস্তাহার বলিতেছে, ক্ষমতায় ফিরিলে পরিকাঠামো খাতে প্রায় ষাট লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হইবে। সরকারের টাকা, না কি বেসরকারি ক্ষেত্রের, সেই হিসাব নাই। ইউপিএ-র আমলে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ এনডিএ-র তুলনায় অনেকখানি বেশি, অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কিন্তু, রাজকোষের যে হাল হইয়াছে, তাহাতে এই বিপুল বিনিয়োগের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দূর অস্ৎ। তিন বৎসরের মধ্যে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারকে ফের আট শতাংশে লইয়া যাওয়ার উচ্চাশাটিও অনুরূপ। শুনিতে অতি চমৎকার, কিন্তু কোন জাদুমন্ত্রে তাহা সম্ভব হইবে, সেই কথাটি স্পষ্ট না করা পর্যন্ত এই প্রতিশ্রুতিকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেওয়ার কারণ নাই। রাজকোষ ঘাটতির হার তিন শতাংশে নামাইয়া আনা এবং সেই স্তরেই তাহাকে বাঁধিয়া রাখিবার প্রতিশ্রুতি লইয়াও মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। নির্বাচনী ইস্তাহার দলের ইচ্ছাপত্র, কিন্তু তাহাকে খোয়াবনামা বানাইয়া ফেলিলে মুশকিল। আম আদমির জন্য বিবিধ অধিকারই হউক বা আয়বৃদ্ধির হারের ঊর্ধ্বগতি, কোনটি কী উপায়ে হইবে সেই অঙ্কের উত্তর কংগ্রেস ত্রৈরাশিকে দিবে, না কি ভগ্নাংশে, না জানা অবধি কথা বাড়াইবার অর্থ হয় না।
আজ যে প্রতিটি প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রেই টাকার প্রশ্ন উঠিতেছে, তাহার দায়ও কংগ্রেসের। মনমমোহন সিংহ-সনিয়া গাঁধীর কংগ্রেসের। তাঁহাদের জমানার পূর্বে কংগ্রেস একটি নীতিতে অবিচলিত ছিল উৎপাদন বৃদ্ধির প্রশ্নে কোনও সমঝোতা নহে। জওহরলাল নেহরুর ‘আধুনিক ভারতের মন্দির’ নির্মাণই হউক বা ইন্দিরা গাঁধীর রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য হইতে কংগ্রেস বিচ্যুত হয় নাই। সনিয়া গাঁধীর আমলে পুনর্বণ্টনে জোর দেওয়ার অত্যুৎসাহে উৎপাদনের প্রশ্নটি কংগ্রেসের রাজনৈতিক মানচিত্রে হারাইয়া গিয়াছিল। তাহার কুপ্রভাব অর্থনীতিতে পড়িয়াছে, তাহাই এখন কংগ্রেসকে তাড়া করিয়া ফিরিতেছে। যথেষ্ট রোজগারের ব্যবস্থা না থাকিলে হাজার ‘অধিকার’ তৈরি করিয়াও যে মানুষের ভাল করা যায় না, কংগ্রেস নেতৃত্ব বহু মূল্যে বুঝিতেছেন। এই বারের ইস্তাহারে উৎপাদনের প্রশ্নটি গুরুত্ব পাইয়াছে। কিন্তু, তাহা মুখের কথা। উৎপাদন ক্ষেত্রে বার্ষিক দশ শতাংশ বৃদ্ধির হার প্রায় অসাধ্য। আর, উৎপাদনে উৎসাহ দিতে যদি আমদানির উপর অতিরিক্ত কর আরোপ বা রফতানি ক্ষেত্রে আর্থিক উৎসাহের ন্যায় পশ্চাৎমুখী নীতি ফিরাইয়া আনিবার কথা ভাবা হয়, তাহা মারাত্মক। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এমন নীতি মানিবে না, তাহা দ্বিতীয় দফার সমস্যা। একুশ শতকের ভারত ফের চল্লিশ বৎসর পিছাইয়া যাইবে, এই ভাবনা এ কে গোপালন ভবন ছাড়া কাহারও স্বস্তির কারণ হইবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy