কথার সুর এবং দেহের ভঙ্গি যদি বাস্তবের যথার্থ প্রতিবিম্ব হইত তবে বলা চলিত যে, অবশেষে গ্রিস এবং জার্মানির বিবাদ ঘুচিয়া সহযোগিতার নূতন সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে এবং ইউরো-র ভবিষ্যত্ও মেঘমুক্ত হইতেছে। গ্রিসের বামপন্থী দল সিরিজা-র প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস এবং জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল এ-যাবত্ পরস্পরের প্রতি যে ভাব প্রদর্শন করিতেন, তাহাকে সখ্য-ভাব বলা চলে না। আর্থিক সংকট হইতে পরিত্রাণের জন্য গ্রিসের সরকারকে বিশেষ সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে উত্তমর্ণ হিসাবে জার্মানির ভূমিকাই অগ্রগণ্য, কারণ মন্দাক্রান্ত ইউরোপে যথার্থ অর্থনৈতিক শক্তি একমাত্র তাহারই আছে। কিন্তু ঠিক সেই কারণেই দুই দেশের সম্পর্কে শৈত্যপ্রবাহ ক্রমশ প্রবল হইতে প্রবলতর। জার্মানির দাবি: আর্থিক সাহায্য লাভের জন্য গ্রিসকে নিজের আর্থিক নীতির আমূল সংস্কার করিতে হইবে। অস্যার্থ, পরের পয়সায় বিলাসিতা চলিবে না। অথচ ‘কৃচ্ছ্রসাধনের চাপে জনবিরোধী নীতি চলিবে না’ বলিয়া প্রবল প্রচারের রথে সওয়ার হইয়াই সিরিজা ক্ষমতায় আসিয়াছে, তাহার পক্ষে এখন বার্লিনের শর্ত পূরণ করা কঠিন।
জনপ্রিয়তার রাজনীতি বনাম সংস্কারের অর্থনীতি— এই সংকটে পড়িয়া রাজনীতির নায়করা সচরাচর যাহা করেন, প্রধানমন্ত্রী সিপ্রাস এবং বিশেষত তাঁহার প্রগল্ভ অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভরুফাকিস তাহাই করিয়াছেন: স্বদেশের নাগরিকদের শিখণ্ডী করিয়া জার্মানি তথা ইউরোপের বিরুদ্ধে তোপ দাগিয়াছেন। যে অস্ত্র তাঁহাদের হাতে, তাহার নাম ‘ব্ল্যাকমেল’। সিপ্রাস ও তাঁহার দলের চেতাবনি: তাঁহারা যতটুকু কৃচ্ছ্রসাধনে রাজি তাহার অধিক চাপ দিলে গ্রিস ইউরো হইতে সরিয়া যাইবে। এই পরিণতি সহজে মানিয়া লওয়া জার্মানি বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ ইউরোর বলয় হইতে বিদায়ের দ্বার এক বার খুলিয়া দিলে ইইউ-এর কাঠামোটিই বিপন্ন হইবে, স্পেনের মতো একাধিক দেশ সেই দরজা দিয়া বাহির হইয়া যাইবার আশঙ্কা দেখা দিবে। সুতরাং আথেন্স হইতে তর্জনগর্জন ক্রমশ চড়িতেছিল, সম্প্রতি ভরুফাকিস নাকি জার্মানির উদ্দেশে আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি অবধি করিয়াছিলেন এবং স্বয়ং সিপ্রাস দাবি তুলিয়াছিলেন, হিটলারের বাহিনী গ্রিসে যে হত্যাকাণ্ড চালাইয়াছিল, বার্লিনকে তাহার ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে! সেই পরিপ্রেক্ষিতে সিপ্রাসের বার্লিন সফর আশার আলো দেখাইয়াছে, মার্কেলের সঙ্গে আলোচনার পরে তাঁহারা যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে বলিয়াছেন, ইউরো-র প্রতি তাঁহারা দায়বদ্ধ।
অতঃপর? সিপ্রাস বিলক্ষণ জানেন যে, বল এখন তাঁহার কোর্টে। সংস্কারের সংশোধিত কর্মসূচি ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দিয়া তিনি ‘ইউরোজোন’ নামক গোষ্ঠীভুক্ত আঠারোটি দেশের অনুমোদিত আর্থিক সাহায্যের সময়সীমা চার মাস বাড়াইয়া লইতে সক্ষম হইয়াছেন। কিন্তু এখনও সেই কর্মসূচির রূপরেখা তিনি দাখিল করেন নাই। জার্মানির জনমত উত্তরোত্তর গ্রিসের বিপক্ষে প্রবল হইতেছে, অধিকাংশ জার্মান নাগরিক বলিতেছেন: গ্রিস ইউরো-র শর্ত মানিতে না চাহিলে ইউরো ছাড়িয়া বাহির হইয়া যাইতে পারে, কিন্তু থাকিলে কৃচ্ছ্রসাধন করিতেই হইবে। জনমতের এই চাপ অনন্তকাল প্রতিহত করা জার্মানির চ্যান্সেলরের পক্ষে সম্ভব নহে। শেষ বিচারে টানাপড়েন চলিতেছে দুই দেশের ভোটদাতাদের মধ্যে। ইউরো থাকুক বা না থাকুক, গণতন্ত্র দীর্ঘজীবী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy