শেষ পর্যন্ত পাড়ুই হত্যা মামলা আবার বিচারপতি দীপঙ্করের দত্তের এজলাসে ফিরাইয়া দিলেন কলিকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র। কয়েক সপ্তাহ আগে এই মামলার অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত অনুব্রত মণ্ডলকে কেন গ্রেফতার করে নাই রাজ্য পুলিশ, তাহার জবাবদিহি করিতে রাজ্য পুলিশের ডিজিকে ডাকিয়া পাঠান বিচারপতি দত্ত। কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়া মধ্যপথে রুদ্ধ হইয়া যায়, কেননা প্রধান বিচারপতি মিশ্র ডিজিকে অব্যাহতি দিয়া মামলাটি বিচারপতি দত্তের আদালত হইতে সরাইয়া স্ব-এক্তিয়ারে লইয়া আসেন। তিন সপ্তাহের জন্য মামলায় স্থগিতাদেশ দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। জনমানসে একটি ধারণার চলাচল শুরু হয় যে এই সিদ্ধান্তের কল্যাণে মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য অভিযুক্ত অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে সুবিচার ও শাস্তিদানের পথ বন্ধ হইল। ধারণাটি নিশ্চয়ই ধারণামাত্র। তবু চলতি সপ্তাহে ওই বিশেষ সিদ্ধান্তটির আমূল পরিবর্তনের ফলে এমন একটি অমূলক ধারণাকে যে সাধারণ মানুষের মন হইতে উৎপাটিত করা গেল, ইহা মঙ্গলজনক বলিতে হইবে। প্রধান বিচারপতিই যে আবার ডিভিশন বেঞ্চের আওতা হইতে বিচারপতির দত্তের নিকট মামলাটি ফিরাইয়া দিলেন, তাহাতে একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হইল। আশা, বিচারবিভাগের কর্মপদ্ধতি বিষয়ে জনসাধারণের আস্থা ফিরিবার রাস্তাও তৈরি হইল।
অভিযুক্ত সম্পর্কে যে প্রশ্নগুলি বিচারপতি দত্ত তুলিয়াছিলেন, সেগুলি অত্যন্ত সঙ্গত। মুখ্যমন্ত্রীর পাশে যে অভিযুক্তকে সহাস্য ও সদর্প বিচরণ করিতে দেখা যায়, কারণে অকারণে মুখ্যমন্ত্রী যাঁহাকে স্নেহদৃষ্টি ও স্নেহবাক্যে অভিষিক্ত করেন, তাঁহার বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ লওয়া কঠিন বলিয়াই পুলিশের এই ঢিলাঢালা ভাব কি না, এই প্রশ্ন নিতান্ত স্বাভাবিক। স্থগিতাদেশ-পরবর্তী পর্বেও দেখা গিয়াছে, শ্রীমণ্ডল নিশ্চিন্ত মনে তাঁহার নিজস্ব অঞ্চলের ভোটগ্রহণ পদ্ধতির তদারক করিতেছেন, মাত্রাতিরিক্ত তদারক— এবং কোনও পুলিশ, কোনও কমিশন দৃশ্যত তাঁহার প্রতাপ প্রতিহত করিবার প্রয়াস করিতেছে না। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবেশ বিষয়ে যে আশঙ্কাপুঞ্জ তৈরি হয়, বিচারবিভাগই সেখানে একমাত্র ভরসার আলোক-প্রতিম। অনুব্রত মণ্ডলের মতো মহাস্থানিক মহামাত্যরা ভোটপর্বে নিজেদের দলের তরফে কী জাদুখেলা দেখাইয়া দিতে পারেন, বামফ্রন্ট জমানাতেও তাহা দেখা গিয়াছে, ‘পরিবর্তন’-এর জমানাতেও তাহার সর্ব লক্ষণ স্পষ্ট।
এইখানেই শেষ প্রশ্নটি নাছোড়ের মতো চাপিয়া ধরে। পাড়ুই মামলায় স্থগিতাদেশ না আসিলে শ্রীমণ্ডল কি এই ভাবে ভোটপর্বে তাঁহার জেলাময় দাপাইয়া বেড়াইতে পারিতেন? গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হইবার পরও আত্মশোধনের চিহ্ন তাঁহার মধ্যে দৃষ্ট হয় নাই, তাঁহার রাজনৈতিক প্রতিপত্তিতে এতটুকু ভাটা পড়ে নাই, জেলার বিভিন্ন নির্বাচন-কেন্দ্রে তাঁহার অনুচররা সদর্পে বিচরণ করিয়াছে, এবং প্রবল জনশ্রুতি— ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া অবাধ ভোটগ্রহণে প্রাচীরসমান বাধা হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার পিছনে কি বিচারবিভাগের এই সাময়িক উদাসীনতার কিছু ভূমিকা নাই? মহামান্য আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা লইয়াও বলিতেই হয়, এ ভাবে কি জনসাধারণের আস্থা অর্জন করা সত্যই সম্ভব? বিলম্বিত বা প্রলম্বিত বিচার কি বিচার-হীনতারই নামান্তর নহে? সংশয়ী যদি সিদ্ধান্ত করেন, তিন সপ্তাহের স্থগিতাদেশ আসলে ভোট-পর্ব নিশ্চিন্তে উতরাইয়া দিবার পন্থা, সেই সংশয় ভুল হইতে পারে, কিন্তু সংশয়ের অবকাশ কি মিথ্যা বা বিলুপ্ত হইয়া যায়? অথচ এই অবকাশ বন্ধ করিবার কাজটিই বিচারবিভাগের পক্ষে সর্বাপেক্ষা জরুরি ছিল। বিচারের রায় যাহাই হউক, বিচার-প্রক্রিয়ার পদ্ধতিগত স্বচ্ছতা ও অভ্রান্তির মাধ্যমে এই প্রাথমিক বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করাই যে কোনও গণতান্ত্রিক সমাজের জীবনরেখা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy