লোকসভা নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদী উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সফর করিয়াছেন। দিল্লি সহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন শহরে এবং বেঙ্গালুরুর মতো তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পের আধুনিক নগরেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শিক্ষার্থী ও কর্মপ্রার্থী তরুণতরুণীদের উপর নিগ্রহ ও লাঞ্ছনার ঘটনায় সারা দেশের পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদীর সরকারও আলোড়িত হইয়াছে। ওই জনজাতীয় মানুষদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা এবং তাঁহাদের বিদেশি কিংবা ‘অপর’ হিসাবে শনাক্ত করিয়া পীড়ন করার অনুদার উন্নাসিকতার প্রতিরোধে ফৌজদারি দণ্ডবিধি সংশোধন হইতে শুরু করিয়া রকমারি ব্যবস্থাগ্রহণ লইয়াও ভাবনা-চিন্তা চলিতেছে। এই অবস্থায় দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনী ইস্তাহারে উত্তর-পূর্বের মানুষদের ‘অভিবাসী’ আখ্যা দিয়া বিজেপি স্বভাবতই প্রবল সমালোচনার মুখে। প্রশ্ন উঠিয়াছে: উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য কি তবে বিজেপির কাছে ‘বিদেশ’?
নির্বাচনের মুখে এমন একটি বিভ্রম সৃষ্টির তীব্র প্রতিক্রিয়া বিশেষত উত্তর-পূর্বের সাত রাজ্যে প্রবল ভাবে দেখা দিয়াছে। বিজেপি নেতৃত্ব পরিস্থিতি সামাল দিতে গোটা বিষয়টিকে ‘ছাপার ভুল’ বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। কিন্তু তাহাতে অন্তত দিল্লি ও উত্তর ভারতে বসবাসকারী ওই জনজাতীয়দের ক্ষোভ প্রশমিত হইবার নয়। এমন একটি ‘ছাপার ভুল’ কেমন করিয়া দলের নির্বাচনী ইস্তাহারে থাকিয়া গেল, তাহা লইয়া গবেষণা চলিবে। কিন্তু সন্দেহ হয়, ছাপাখানার ভূতটি দলীয় চেতনাতেই জন্ম লয় নাই তো? সন্দেহ অহেতুক নহে। ভারতীয় মূল ধারার জনসমাজে প্রান্তীয়দের প্রতি, ‘অন্য রকম দেখিতে’ জনজাতীয়দের প্রতি অবিশ্বাস ও সন্দেহের বীজটি বহু কাল ধরিয়াই অঙ্কুরিত ও পল্লবিত। থাকিয়া-থাকিয়া সেই অবিশ্বাস, ‘অপর’-এর প্রতি সেই অসহিষ্ণুতা ওই মানুষগুলিকে হেনস্থা-হয়রান বা নিগ্রহ করিয়া তৃপ্ত হইতে চায়। দিল্লিতে ইতিপূর্বে এ ধরনের বৈরপ্রসূত হামলায় অরুণাচলের ছাত্র নিদো টানিয়া নিহত হইয়াছেন। মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও অসমের জনজাতীয়রাও দেশের নানা স্থানে কেবল তাঁহাদের ভিন্ন চেহারা, ভাষা ও লোকাচারের জন্য প্রতিবেশীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হন। ভিন্নতা ও বহুত্বকে চিন্তার সর্ব স্তরে শিরোধার্য করিতে না-পারার জন্যই অচেনার প্রতি সন্দেহ ও সংশয় অসহিষ্ণু উগ্রতায় পরিণত হয়।
দিল্লি, গুড়গাঁও, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র—সর্বত্রই কেবল সাধারণ মানুষ নয়, পুলিশও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষদের হেনস্থা করে। আগ্রায় কিছু দিন আগেই অসমের এক দল পর্যটককে নিরাপত্তারক্ষীরা ‘বিদেশি’ ভাবিয়া তাজমহল চত্বরে ঢুকিতে দেয় নাই। মানসিকতার এই সমস্যা একা বিজেপির নয়, ইহা একটি সার্বিক সামাজিক সংকীর্ণতা। অশিক্ষা এবং অজ্ঞতাও সমান দায়ী। বিশেষত দেশের ভৌগোলিক ও জনবিন্যাসের অপার বৈচিত্র সম্পর্কে সমূহ অজ্ঞতা। মুখে আসমুদ্রহিমাচল ভারতের কথা বলিলেও উত্তর ভারতের বাহিরে বিস্তৃত ভূখণ্ড ও সেখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে অজ্ঞতা এ দেশে ব্যতিক্রমী নয়। আইনি বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা লইয়া ইহার প্রতিবিধান সম্ভব নয়। চাই ভারতের বহুত্ব, তাহার ভাষা-সংস্কৃতি, জনগোষ্ঠী, লোকাচারের বিভিন্নতা, চেহারা-গাত্রবর্ণ-মুখাবয়বের নানাত্ব বিষয়ে ধারাবাহিক ও নিরবচ্ছিন্ন চর্চা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy