Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ছি! বলিতে নাই

নি র্বাচনী সমাবেশে নরেন্দ্র মোদীর বাক্পটুতার খ্যাতি আছে। খ্যাতির কারণও আছে। ভারতীয় জনসভায় সমবেত শ্রোতারা যেমন বক্তৃতা পছন্দ করেন, তিনি তেমন বক্তৃতা করিতে দক্ষ। বিশেষত, প্রতিপক্ষের উদ্দেশে চোখা চোখা বাক্যবাণ বর্ষণে তাঁহার কুশলতা প্রশ্নাতীত। তাঁহার ভাষণ শুনিয়া এবং ভাষণ দানের সময় তাঁহার মুখভঙ্গিমা ও দেহসঞ্চালন দেখিয়া এমন কথা মনে করিবার কারণ আছে যে, নুন লঙ্কা গোলমরিচ মিশ্রিত আপন উচ্চারণগুলি তিনি অত্যন্ত উপভোগ করেন।

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

নি র্বাচনী সমাবেশে নরেন্দ্র মোদীর বাক্পটুতার খ্যাতি আছে। খ্যাতির কারণও আছে। ভারতীয় জনসভায় সমবেত শ্রোতারা যেমন বক্তৃতা পছন্দ করেন, তিনি তেমন বক্তৃতা করিতে দক্ষ। বিশেষত, প্রতিপক্ষের উদ্দেশে চোখা চোখা বাক্যবাণ বর্ষণে তাঁহার কুশলতা প্রশ্নাতীত। তাঁহার ভাষণ শুনিয়া এবং ভাষণ দানের সময় তাঁহার মুখভঙ্গিমা ও দেহসঞ্চালন দেখিয়া এমন কথা মনে করিবার কারণ আছে যে, নুন লঙ্কা গোলমরিচ মিশ্রিত আপন উচ্চারণগুলি তিনি অত্যন্ত উপভোগ করেন। এই আত্ম-উপভোগ বাগ্মীদের পরিচিত স্বভাবলক্ষণ— নিজের কথা ভাল না বাসিলে ডাকসাইটে বক্তা হওয়া যায় না। এই স্বভাবের একটি বিপদও আছে। আপন বাগ্মিতার বেগে পাগলপারা হইয়া পড়িবার বিপদ। কোথায় থামিতে হয় তাহা না জানিবার বিপদ। কোথায় কী বলিতে নাই তাহা বিস্মৃত হইবার বিপদ। নরেন্দ্র মোদী সেই বিপদে পড়িয়াছেন। তিনি বিদেশের মাটিতে দাঁড়াইয়া এমন কথা বলিয়া আসিয়াছেন যাহা জনসভায় দলীয় প্রচারে করতালি আকর্ষণ করিতে পারে, কিন্তু সফররত প্রধানমন্ত্রীর মুখে সম্পূর্ণ বেমানান।

কানাডার টরন্টো শহরে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সভায় ভাষণ দানের সময় প্রধানমন্ত্রী বলিয়া আসিয়াছেন, যাঁহাদের আবর্জনা ছড়াইবার, তাঁহারা আবর্জনা ছড়াইয়া গিয়াছেন, তিনি এখন সেই সকল জঞ্জাল পরিষ্কার করিতেছেন। অর্থাৎ পূর্ববর্ত়ী ইউপিএ জমানায় ভারত দুর্নীতির পাঁকে ডুবিয়াছিল, তাঁহার সরকার সেই পঙ্ক উদ্ধারে মগ্ন। ইউপিএ-র দ্বিতীয় দফায় দুর্নীতির অভিযোগ প্রবল আকার ধারণ করিয়াছিল, সেই দুর্নীতি নিবারণে ও তাহার শাস্তি প্রদানে মনমোহন সিংহের সরকারের অক্ষমতা বা অনীহা অবশ্যই অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ ছিল। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে সরকারের এই ব্যর্থতাকে বিরোধী নায়ক হিসাবে নরেন্দ্র মোদী অত্যন্ত সাফল্যের সহিত ব্যবহার করিয়াছিলেন। বিজেপির দিল্লি জয়ের পিছনে তাহার অবদান সম্ভবত বিপুল। কিন্তু তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন, এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নহেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তাঁহাকে দল বা গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে উঠিতে হইবে, ভারত রাষ্ট্রকে রাষ্ট্র হিসাবে দেখিতে হইবে, সরকার হিসাবে নয়। এই ভুল প্রধানমন্ত্রীকে মানায় না। বস্তুত, পশ্চিম দুনিয়া নরেন্দ্র মোদীকে বিশেষ সম্মান করিতেছে তাঁহার উন্নয়ন-প্রসারী ভূমিকার জন্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাম্প্রতিক প্রশস্তিও সেই ধারার অনুসারী। মোদীর ফ্রান্স, জার্মানি এবং কানাডা সফরেও ভারতের আর্থিক সংস্কার এবং উন্নয়নের কথাই প্রধানত আলোচিত হইয়াছে। মোদী যথার্থ সংস্কার বিশেষ কিছু করিয়া উঠিতে পারেন নাই, প্রত্যাশা জাগাইয়াছেন। তাঁহার কাজ সেই প্রত্যাশা পূরণে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা। মনমোহন সিংহ অতীত, তাঁহার সরকারের ‘আবর্জনা’ ঘাঁটিয়া মোদী নিজের হাতই নোংরা করিতেছেন।
কংগ্রেস নেতারা প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণের প্রতিবাদ করিয়াছেন। প্রতিবাদ সঙ্গত, স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁহারা হুমকি দিয়াছেন যে, নরেন্দ্র মোদী যখন যে দেশে সফর করিতে যাইবেন, কংগ্রেসের প্রতিনিধিরাও তাঁহার পিছু পিছু যাইবেন এবং তিনি কোনও অন্যায় ভাষণ দিলে তাঁহারা তৎক্ষণাৎ তাহা খণ্ডন করিতে প্রতিভাষণ দিবেন। অস্যার্থ, নির্বাচনী প্রচার বা দলীয় তরজার ধারাটি দেশের সীমান্ত অতিক্রম করিয়া বৃহত্তর দুনিয়ায় প্রবাহিত হইবে। আশা করা যায়, সনিয়া গাঁধী এবং তাঁহার পারিষদবর্গ নিতান্তই ক্রোধের তাড়নায় এই হুঙ্কারটি ছাড়িয়াছেন, ভাবিতে বসিলে তাঁহারাও বুঝিবেন যে, এমন কাণ্ড শুরু করিলে নরেন্দ্র মোদীর আচরণকেই স্বীকৃতি দেওয়া হইবে এবং বিশ্বের দরবারে ভারতের ভয়াবহ অমর্যাদা ঘটিবে। সর্বদলীয় অমর্যাদা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE