নির্বাচনী জনসভায় আর পাঁচটি প্রসঙ্গের সহিত বাংলাদেশ হইতে বেআইনি অনুপ্রবেশের কথাটিও উঠিয়াছে এবং যথারীতি তাহা তরজায় হারাইয়া গিয়াছে। অন্ধকারতম রাত্রিও ফুরায়। এ বারের মতো নির্বাচনী জনসভারও অদ্যই শেষ রজনী। আগামী কাল অপরাহ্ণে যবনিকা পতন। কিন্তু প্রচার থামিলেও অনুপ্রবেশের প্রশ্নটি হারাইয়া যাইবে না। কারণ, তাহা ঘোর বাস্তব। বেআইনি অনুপ্রবেশ ছিল এবং আছে। ভাবগতিক দেখিলে প্রত্যয় হয়, থাকিবেও। সীমান্ত অতিক্রমী লোকচলাচল প্রায় অবাধ। বাধা যেটুকু আছে, শোনা যায় তাহা কাঞ্চনমূল্যে অপসারণযোগ্য। যে দিকে ঢাল, জল সে দিকেই বহিবে। ইহাই জলের ধর্ম। তেমনই, যাতায়াতে বাধা না থাকিলে যে দিকে সুযোগসুবিধা বেশি, মানুষও সে দিকেই যাইবে। পশ্চিমবঙ্গের না হউক, সামগ্রিক ভাবে ভারতের আর্থিক অবস্থা বাংলাদেশের তুলনায় ভাল। রোজগারের সুযোগ বেশি, জীবনযাপনের অন্যান্য সুযোগও। কাজেই, সীমান্ত কার্যত অবাধ হইলে জনপ্রবেশ ঘটিয়া চলিবে, ইহাই স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক হইলেও, তাহা গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। বাংলাদেশ একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। কেন বাংলাদেশকে পৃথক রাষ্ট্রই হইতে হইল, কেন ভাষায়-সংস্কৃতিতে অভিন্ন হইয়াও কাঁটাতারের দুই পারের বাঙালি দুই ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক, এই প্রশ্নগুলি কাহারও আবেগ জাগ্রত করিতে পারে, কাহারও ইতিহাসচেতনা। কিন্তু, তাহাতে বাস্তব বদলায় না। অবৈধ ভাবে যাঁহারা ভারতে প্রবেশ করিতেছেন, তাঁহাদের রুজিরোজগারের ব্যবস্থা করা ভারতের দায়িত্ব নহে। এই অনুপ্রবেশ অবিলম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকরা সম্ভবত সেই বিকল্পটি ভাবিয়া দেখেন নাই। তাঁহাদের নিকট অনুপ্রবেশকারীদের পরিচয়, সম্ভাব্য ভোটার। ফলে, বাম আমলে রীতিমত প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে এই অনুপ্রবেশকারীদের রেশন কার্ডের বন্দোবস্ত হইত। শাসক পাল্টাইয়াছে, কিন্তু এই ব্যবস্থার বদল হইয়াছে বলিয়া মনে করিবার কোনও কারণ নাই। এই ভোটের রাজনীতি পরিত্যাজ্য। অনুপ্রবেশ বন্ধ করিবার উপায় আছে। তাহার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সমন্বয় প্রয়োজন। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনও প্রাকৃতিক সীমান্ত নাই, ফলে কার্যকর প্রতিরোধের ব্যবস্থা জরুরি। কাঁটাতার তেমন একটি ব্যবস্থা হইতে পারে, অন্য উপায়ও ভাবা সম্ভব। জরুরি কঠোর নজরদারিও। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দক্ষতা ও নীতিনিষ্ঠাও কম গুরুত্বপূর্ণ নহে। তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
কিন্তু অর্থনীতির অসামঞ্জস্যের বাস্তবটি যত দিন থাকিবে, চলাচল এবং লেনদেনের প্রবণতা অনিবার্য। বেআইনি অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি যেমন প্রয়োজন, তেমনই বাস্তবকে গুরুত্ব দেওয়াও বিধেয়। প্রয়োজন সুপরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণ। প্রথমেই অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ করিতে হইবে। বাণিজ্য অবশ্যই চলিবে, কিন্তু তাহা নির্দিষ্ট পথে, নির্দিষ্ট বিধি মানিয়া। সেই বাণিজ্যের সহিত যাঁহারা যুক্ত, তাঁহাদেরও আইনি স্বীকৃতি থাকিতে হইবে। যাঁহারা বাংলাদেশ হইতে ভারতে কাজ খুঁজিতে আসেন, তাঁহাদেরও বিধি মানিয়া ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ইত্যাদি লইতে হইবে। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে তাহার পুনর্নবীকরণও আবশ্যিক। বিশ্বের বহু দেশেই অভিবাসী শ্রমিকরা কাজ করেন। ভারতেও তেমন কাজের বাজার আছে। কিন্তু আইনি পথে সাময়িক ভাবে কাজ করিতে আসা এক কথা, পাকাপাকি ভাবে চলিয়া আসা আর এক। দ্বিতীয়টি কোনও দেশের পক্ষেই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না, ভারতের মতো জনবহুল, বেকারবহুল এবং অনগ্রসর দেশের পক্ষে তো নয়ই। শ্রমের বাজার এক কথা, বসতির স্থান অন্য কথা। ছাড়পত্রের মেয়াদ ফুরাইলে শ্রমিকরা যাঁহাতে স্বদেশে ফিরিয়া যান, তাহা নিশ্চিত করা প্রশাসনের কর্তব্য। রাজনীতির ঘোলা জলে কর্তব্যটি যাহাতে হারাইয়া না যায়, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy