Advertisement
E-Paper

তোমাদের বন্দুকের গুলি ফুরোয়, চপার ভোঁতা হয়ে যায়, আমাদের তুলিকলম দিনে দিনে আরও ধারালো

সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা লুকিয়েচুরিয়ে করা যায় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ছাড়া কোনও পরিত্রাণ নেই। শিল্পসাহিত্যে তো একেবারেই নেই। বাংলাদেশের একটি নতুন সিনেমা সে সত্য আবার মনে করিয়ে দিল।তানভীর মোকাম্মেল বাংলাদেশের সিনেমাকার, এ দেশেও পরিচিত। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন, আন্তর্জাতিক কিছু পুরস্কারও। তথ্যচিত্র ও কাহিনিচিত্র, দুইই তাঁর নির্মাণক্ষেত্র। তাঁর অনেকগুলি সিনেমা অনেক বারই দেখেছি এক বিশেষ ধরনের টানে।

দেবেশ রায়

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৫ ০০:০০

তানভীর মোকাম্মেল বাংলাদেশের সিনেমাকার, এ দেশেও পরিচিত। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন, আন্তর্জাতিক কিছু পুরস্কারও। তথ্যচিত্র ও কাহিনিচিত্র, দুইই তাঁর নির্মাণক্ষেত্র। তাঁর অনেকগুলি সিনেমা অনেক বারই দেখেছি এক বিশেষ ধরনের টানে। তাঁর তথ্যচিত্রে কাহিনিচিত্রের অনেক উপাদান ঢুকে যায় অনায়াসে, কাহিনিই তথ্যের ভিত্তি তৈরিতে কাজে লাগে। আবার, তাঁর কাহিনিচিত্রে তথ্যচিত্রের অনেক উপাদান ঢুকে যায় গল্পের ভিত গাঁথতে। কিন্তু কোথাওই এটা কারুকৌশল হয়ে ওঠে না। সিনেমাকারের মন ও চিন্তা থেকেই রচিত হয় কাহিনির আখ্যান বা তথ্যের আখ্যান। তানভীর যে আখ্যান স্বতন্ত্র ভাবে বিচার করেন, তার ভিন্নতর প্রমাণ আছে ঔপন্যাসিক ওয়ালিউল্লাহ্ সম্পর্কে তাঁর গোটা একটি বইয়ে।

তানভীরের শেষ ছবি ‘জীবনঢুলি’ কলকাতার গোর্কি সদনে প্রথম যে দিন দেখানো হয়, আমি ছিলাম ও প্রত্যুত্‌পন্ন মুগ্ধতা বোধ করি। ঘটনাক্রমে গত বছর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এক দিন ঢাকাতে যখন, বোধহয় প্রথম, দেখানো হল সে দিনও আমি ছিলাম। যে পথে অভিজিত্‌ রায়কে খুন করা হল, গোঁড়া গুন্ডারা তাঁকে অতটাই কোপাতে পারল একটা মেলার মধ্যেই প্রায়, সেই পথ ধরেই তো আমরা যাচ্ছিলাম হলের দিকে, যেখানে সিনেমাটা দেখানো হবে।

‘জীবনঢুলি’ ভারতে বাণিজ্যিক স্তরে দেখানো শুরু হবে। এই সিনেমায় পাক বাহিনীর ১৯৭০ সালের মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী সাম্প্রদায়িক সামরিক অভিযানের কাহিনি দেখানো হয়েছে অনাবিল স্পষ্টতায়, তথ্যভিত্তি একটুও না বদলিয়ে, কাহিনির অভিঘাতকে সরল বোধগম্য রেখে। প্রথম দেখার পরে মনে হয়েছিল, এ যেন এক সমুদ্যত গ্রিক ট্র্যাজেডি, যেখানে সত্য ছাড়া আর কিছুই নেই।

এতটা সত্য কি ভারতীয় গণতন্ত্রও সইতে পারে? ২০১৩’র ২০ অগস্ট প্রবীণ মরাঠি চিকিত্‌সক নরেন্দ্র দাভলকর আততায়ীদের আক্রমণে নিহত হন প্রকাশ্য রাজপথে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি গোবিন্দ পানসারে খুন হয়ে গেলেন লোকচলাচলের পথের ওপরে। অথচ এঁরা রাজনীতির কথা বলেননি, বলেছেন যথাক্রমে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং শিবজির প্রজাদরদি রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে। বিনায়ক সেনকে হাজত খাটতে হল তিনি আদিবাসীদের মধ্যে ডাক্তারি করছিলেন বলে আর কিশোরী ছাত্রী দেবলীনা চক্রবর্তীকে দিনের পর দিন জেলে আটকে রাখা হল এমন এক মামলায় যার একটাতেও বোধহয় এখনও চার্জশিট দেওয়া হয়নি। নির্বাচিত গণতন্ত্রও এই ধরনের আততায়ী গোঁড়াদের বিরুদ্ধে কোনও গ্যারান্টি নয়, যেমন বাংলাদেশের গোঁড়া ইসলামবাদী ও গণতান্ত্রিক সমাবেশের দ্বন্দ্বও এই গোঁড়াদের সংগঠিত হত্যা-অভিযানের একমাত্র কারণ নয়।

এই মতান্ধ, বিশ্বাসান্ধ, ধারণান্ধ গোঁড়াদের কোনও রকম যুক্তি নেই। তাদের মনে সব সময় বাস্তুচ্যুত হওয়ার আতঙ্ক কাজ করে। সে আতঙ্ক স্নায়বিক। যেমন পরাক্রান্ত শিকারি বাঘও আসলে ভিতু, মানুষকে ভয় পায়। সে আত্মরক্ষার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াতেই আক্রমণ করে। মতান্ধ, বিশ্বাসান্ধ, ধারণান্ধ গোঁড়াদের সংগঠিত করে কাজে লাগাতে পারে রাজনৈতিক দল। নইলে, ঝাড়ফুঁক, ডাইন, নজর-দেওয়া, ওঝাগিরি, এ-সব তো হিন্দুধর্মের মূল কোনও ধারার অন্তর্গত নয়। কতকগুলো জনগোষ্ঠীগত ধারণাকে তান্ত্রিক ধারণার সঙ্গে যুক্ত করে একে হিন্দু আচার বানানো হয়েছে। নইলে, ডাক্তার দাভলকর তো শুধু বলেছিলেন, যে-সব অপ্রমাণিত চিকিত্‌সার ফলে নিরাময়যোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যু ঘটে, সেগুলিকে নিষিদ্ধ করতে। পানসারে তো শুধু বলেছিলেন, শিবজির কৃতি অনেক বড়, তিনি প্রজাহিতৈষী শাসক ছিলেন। কিন্তু একেই সেই মতান্ধ, বিশ্বাসান্ধ, ধারণান্ধ গোঁড়ারা বাস্তুচ্যুত হওয়ার ভয়ে আতঙ্কিত আক্রমণ করল, যেমন করেছে হুমায়ুন আজাদকে, অভিজিত্‌কে।

তানভীরের ‘জীবনঢুলি’ শুরুই হয় ১৯৭০ সালের ভোট দিয়ে ও সেই ভোটের ফল অনুযায়ী শেখ মুজিবের পূর্ব পাকিস্তানের শাসন-অধিকার দাবি নিয়ে। এই শুরুটা ঘটছে সিনেমার ভাষায়। শুধু শুরুতে নয়, গোটা সিনেমাটিতেই কথা ব্যবহার করা হয়েছে নেহাতই নিতান্তপক্ষে। শুধু গাছের মাথা আর নৃত্যরত আঙুলের ডগা, আর লাল পাড় ঘেরা পায়ের সামান্য নৃত্যভঙ্গি আর ধুতি-পরা খালি পায়ের পুরুষালি ছন্দ। হিন্দুদের নিয়েই কথা হচ্ছে ও শেখ মুজিবের দাবির সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তানে এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের সম্ভাবনা নিসর্গের সঙ্গে ও সামাজিক সব সমাবেশের সঙ্গে এক হয়ে যাচ্ছে। শেখ মুজিবের দাবি ও সেই দাবির প্রতি বিভিন্ন স্তরের হিন্দুদের সমর্থন হরিসভা থেকে দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠানে গিয়ে শেষ হয়। এ-কথাও জানিয়ে দেওয়া হয় যে, দুর্গোত্‌সবে হিন্দু উচ্চবর্ণের আর নিম্নবর্ণের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা ও জায়গা আলাদা।

তারই ভিতর গ্রামজীবনের স্বসম্পূর্ণতার সংগতিপূর্ণ ছবি তানভীর তৈরি করে তোলেন। ঠিক ছবি নয়, ছবির পরম্পরা। কিন্তু কোথাও তানভীর এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি। গ্রামের রোজকার জীবনটার প্রতিমা খুঁজছিলেন তিনি। মুখ্য চরিত্র জীবনঢুলি নানান দৃশ্য ও ঘটনাপুঞ্জের মধ্য দিয়ে ঢাক কাঁধে এমন হেঁটে যায়, যেন ওই ঢাকটা তার শরীরের অঙ্গ। অথচ এই ঢাক-বাজানো নিয়ে কোনও রকম নাটুকেপনা বা অতিরিক্ত পারদর্শিতা দেখানো হয় না। এটা জীবনেরই অংশ, রোজকার জীবন প্রধানত পুনরাবৃত্তিশীল। জীবনঢুলি ওই ঢাক কাঁধে এক জন সাক্ষা ও এক জন সাক্ষীই মাত্র। সিনেমার পরবর্তী অংশের যুদ্ধ ও হত্যার পরিস্থিতিতেও এই সাক্ষীর ভূমিকাটাই প্রধান হয়ে ওঠে। তার কোনও সক্রিয়তা নেই। এমনকী সমস্ত পরিবার রাজাকারদের হাতে খুন হয়ে যাওয়ার পরও তার চোখে জল নেই, তার শরীরে প্রতিশোধ নেই। জীবনঢুলি মানুষটির এই সাক্ষী-সত্তা তানভীর প্রথম দিকে গ্রামের সমষ্টিজীবনের সঙ্গে গেঁথে দিয়েছেন। গ্রিক ট্র্যাজেডির কথাই যে বার বার মনে আসছিল সে এই কারণেই হয়তো— ঘটনা ঘটে যায় এক সরল ভবিতব্যতায়।

ভেবে নেওয়া যায়, দুর্গাপ্রতিমার বিসর্জন পর্যন্ত উপস্থাপন-অধ্যায়। বিসর্জন থেকে ফেরার পথেই জীবনঢুলি দেখে হেলিকপ্টারে পাক সৈন্য নামছে, ট্রাকে, সেনাবাহিনীর গাড়িতে। তার পর এক সময় সে দেখতে পায় আওয়ামি লিগের স্থানীয় নেতারা রাস্তায় পড়ে আছেন রাজাকারদের গুলিতে মৃতদেহ হয়ে। দেশ ছেড়ে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত অনিবার্য হয়ে ওঠে। শুরু হয় দেশ ছেড়ে যাওয়া, পায়ে হেঁটে, নৌকোয়, নদীর পাড় ধরে, নদী-খাল পারাপার করে, যেখানে সেখানে দিনে একটু বিশ্রাম, রাতে একটু ঘুমোনো।

হত্যা শুরু হয়ে গিয়েছিল বিজয়া দশমীর রাত থেকেই। তার পর হত্যা যেন হয়ে উঠল প্রতিটি বেঁচে-থাকা মুহূর্তের বাধ্যতা। গুনে শেষ করা যায় না এমন গণহত্যা। আর তার আনুষঙ্গিক অপরাধগুলি। মৃতের শরীর থেকে মূল্যবান যা কিছু পাওয়া যায় তা লুট করা।

সেই বিসর্জনের রাত থেকে ছ-ছটি পরিচ্ছেদে এই নিম্নবর্ণ-হিন্দু-হত্যার বিবরণ, স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে জীবনঢুলির গ্রামে ফিরে আসা ও তিন-চার পরিচ্ছেদ জুড়ে রাজাকার-শাসিত পুব বাংলার গ্রামে তার জীবনযাপন। এরই ভিতর মুক্তিবাহিনীর অভিযান শুরু, শেষ পর্যন্ত মুক্তি। শেষ তিন-চারটি পরিচ্ছেদে কাহিনিচিত্রের রূপক তৈরি হতে থাকে, দৃশ্যগুলিও সেই অনুযায়ী নির্মিত হতে থাকে।

তানভীরের সিনেমাটি, হুমায়ুন আজাদের লেখালিখি, অভিজিত্‌ রায়ের ব্লগ-অভিযান ও তসলিমা নাসরিনের লেখাপত্র একসঙ্গে ভাবলে আন্দাজ করা যায় বাংলাদেশের এই চিন্তাকর্মীরা কী গভীর প্রস্তুতি ও সাহস নিয়ে তাঁদের স্বনির্ধারিত কাজ করে যাচ্ছেন, সেগুলি শিল্পের এবং মননের নিরিখে কতটাই বড় কাজ।

২০০১-এ বাংলাদেশের ‘সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন’-এর পক্ষ থেকে ‘নির্যাতনের দলিল— ২০০১/ নির্বাচনপূর্ব ও নির্বাচন-উত্তর সংখ্যালঘু নিপীড়ন’ নামে ৩০৯ পৃষ্ঠার একটি বই বেরিয়েছিল ঢাকায়। প্রকাশকের ভূমিকায় বলা হয়েছিল, এটি ‘সরেজমিনে দেখে এসে সাংবাদিকদের প্রতিবেদন, বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত।’

আমাদের দৈনিকগুলিও এমন বিবরণ কিছু কিছু ছাপে। তবে সব সময় সবটা নয়। এক জায়গার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অন্যত্র উশকোনোর কাজে না লাগানো হয়, সে-বিষয়ে আমাদের কাগজগুলোর দায়িত্ববোধ মোটামুটি প্রমাণিত।

কিন্তু এখন পরিবেশ-পরিস্থিতি, আমাদের দেশের, বদলে যাচ্ছে। এখন ভারতের প্রধান ‘মেজরিটারিয়ান’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী পার্টি কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় এসেছে। ২০০২-এর গুজরাত কাণ্ডে যাঁরা লোকধারণায় প্রধান অভিযুক্ত, তাঁরাই কেউ কেউ এখন কেন্দ্রীয় রাজনীতির প্রধান নেতা। সর্বভারতীয় নানা প্রতিষ্ঠানে এমন ব্যক্তিরা কর্মকর্তা হিসেবে মনোনীত হচ্ছেন যাঁদের বিদ্যাচর্চায় প্রাচীন ভারত সম্পর্কিত সিদ্ধান্তগুলি পদ্ধতিগত ভাবে অবৈজ্ঞানিক ও সাম্প্রদায়িক।

তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবনঢুলি’ ছবিটি এ দেশের বাণিজ্যিক বৃত্তে দেখানো হলে আমাদের চোখ ও গলার আড় কিছুটা কাটতে পারে। আমাদের চোখে পড়ে যেতে পারে, মধ্যবিত্ত-প্রভাবিত দৈনন্দিন জীবনে, পশ্চিম বাংলায়, সাম্প্রদায়িকতা কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তানভীর ও তাঁর সহকর্মীরা হয়তো আমাদের মনে করিয়ে দিতে পারবেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা লুকিয়েচুরিয়ে করা যায় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ছাড়া কোনও পরিত্রাণ নেই।

শিল্পসাহিত্যে তো একেবারেই নেই। গান, সিনেমা, থিয়েটার, গল্প-উপন্যাসে দৈনন্দিন সাম্প্রদায়িকতার কাহিনি সবচেয়ে স্পষ্ট হতে পারে। রাজনীতি ও সাংবাদিকতার বড় জায়গায় এই দৈনন্দিন তুচ্ছ হয়ে যেতে পারে।

তানভীরের ছবিটি দেখে মনে হল, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী সেই আখ্যানগুলি শিল্পকৃতি হিসেবে যত উচ্চতর হবে, সাম্প্রদায়িকতা ততই অপ্রাসঙ্গিক হতে থাকবে, আমাদের আধুনিক জীবনের পক্ষে অপ্রাসঙ্গিক ও বাতিক। উচ্চতম শিল্পকৃতির চেষ্টাই মতান্ধ, বিশ্বাসান্ধ, ধর্মাচারান্ধ গোঁড়াদের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী ও সক্রিয় অস্ত্র। ওদের চপার আছে, বন্দুকও আছে। আমাদের তুলি-কলম-গলা ও শরীর দিয়ে তৈরি শিল্প আছে। বন্দুকের গুলি ফুরোয়, চপার ভোঁতা হয়ে যায়, শিল্প দিনে দিনে নতুন ও ধারালো হয়।

‘জীবনঢুলি’ ছবির একটি দৃশ্য

post editorial debesh roy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy