Advertisement
E-Paper

দশ বছরের অগৌরব

গত শুক্রবার পঞ্চদশ লোকসভার শেষ অধিবেশন সমাপ্ত হইয়াছে। ইহাতে কোনও অভিনবত্ব নাই। যাহার শুরু আছে, তাহার শেষও আছে। সভার সমাপ্তিদিবসে পরিচিত বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি যে অপরিচিত সৌজন্যের প্রদর্শনী, তাহাকেও লোকাচারের অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণ নাই। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি একটি ঘটনা ঘটিয়াছে, যাহা কেবল অভূতপূর্ব নয়, বিশেষ ভাবে অর্থবহও।

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ১৪:৫৩

গত শুক্রবার পঞ্চদশ লোকসভার শেষ অধিবেশন সমাপ্ত হইয়াছে। ইহাতে কোনও অভিনবত্ব নাই। যাহার শুরু আছে, তাহার শেষও আছে। সভার সমাপ্তিদিবসে পরিচিত বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি যে অপরিচিত সৌজন্যের প্রদর্শনী, তাহাকেও লোকাচারের অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণ নাই। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি একটি ঘটনা ঘটিয়াছে, যাহা কেবল অভূতপূর্ব নয়, বিশেষ ভাবে অর্থবহও। এই দিন মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দুইটি লোকসভার কার্যকাল সম্পূর্ণ করিয়াছেন। ইহা আপাতদৃষ্টিতে কোনও নূতন কৃতি নহে, দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় তিনি তিন নম্বর, নিরবচ্ছিন্ন মেয়াদের বিচারে দুই নম্বর। কিন্তু একটি ব্যাপারে তাঁহার কোনও জুড়ি নাই। মনমোহন সিংহ লোকসভার সদস্য না হইয়া দুই দফায় দশ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকিয়া গেলেন। চণ্ডীদাসের খুড়োর পরে এমন অতুল কীর্তি আর কেহ রাখিয়াছেন কি? গণতান্ত্রিক সরকারের যিনি প্রধান কর্ণধার, তিনি সরাসরি জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত নহেন এই কীর্তি গৌরবের বলিলে ভাবের ঘরে ডাকাতি হইবে।

প্রশ্নটি আইনের নয়। রাজ্যসভার সদস্যের প্রধানমন্ত্রী হইতে আইন তথা সংবিধানের কোনও বাধা নাই। বাধা থাকা বিধেয় ছিল কি না, তাহা গুরুতর প্রশ্ন। সংসদীয় গণতন্ত্রের যে কাঠামোটি ভারতে গৃহীত হইয়াছে, তাহাতে দুই সভার অবস্থান অসমান। ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়তার প্রতিভূ’ বা ‘উচ্চতর কক্ষ’, যে ভাবেই রাজ্যসভাকে মহিমান্বিত করা হউক না কেন, সত্য ইহাই যে, জনপ্রতিনিধিত্বের মৌলিক মাপকাঠিতে লোকসভাই প্রথম এবং প্রধান, রাজ্যসভা তাহার পরিপূরক মাত্র। ওয়েস্টমিনস্টার অনুপ্রাণিত এই কাঠামোয় শাসনবিভাগের পরিচালকরা আইনসভার নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য হইতেই আসেন। সেই ব্যবস্থার স্বাভাবিক নৈতিক দাবি: তাঁহারা জনসাধারণের দ্বারাই নির্বাচিত হইবেন, কারণ তাহা হইলেই জনপ্রতিনিধিত্বের শর্তটি যথার্থ ভাবে পূরণ করা হয়, তাঁহাদের প্রশাসনের হাল ধরিবার নৈতিক অধিকার যথেষ্ট দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে। নৈতিকতার এই দাবিকে আইনের চশমা পরিয়া দেখিলে মস্ত ভুল হইবে। নৈতিকতার স্থান আইনের সীমার বাহিরে। বস্তুত, এই কারণেই যুক্তি দেওয়া যায়, মন্ত্রিসভার সদস্যরা যাহাতে কেবল লোকসভা হইতেই আসিতে পারেন, সংবিধানেই তাহা নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া বিধেয় ছিল। যুক্তিটি যথেষ্ট জোরদার।

এই যুক্তির জোর বহুগুণ বাড়াইয়া দিয়াছে ভারতীয় সংসদের বাস্তব ইতিহাস। পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যসভা নির্মাণের পিছনে গণতন্ত্রের ‘পরিস্রুতি’র যে আদর্শ ছিল, কার্যক্ষেত্রে তাহা মান্য হয় নাই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী এবং নেতা-নেত্রীর স্বার্থ বা আকাঙ্ক্ষা পূরণের উদ্দেশ্যে রাজ্যসভাকে ব্যবহার করা হইয়াছে। বিশেষত, প্রতিযোগিতার রাজনীতির ময়দানে যে নেতারা সফল নহেন, তাঁহাদের সংসদে আনিবার খিড়কি হিসাবে রাজ্যসভা ব্যবহৃত হইয়াছে। নেতা বলিয়াই তাঁহারা অতঃপর প্রশাসনের গুরুদায়িত্ব পালন করিয়াছেন। অর্থাৎ রাজ্যসভার সদস্য হিসাবেই তাঁহারা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হইয়া কাজ করিয়াছেন। মনমোহন সিংহ ইহারই এক চূড়ান্ত নজির। লক্ষণীয়, দশ বছরের রাজত্বে কংগ্রেস তাঁহাকে কোনও ‘নিরাপদ’ কেন্দ্র হইতে লোকসভায় নির্বাচিত করাইয়া আনা দলের পক্ষে কঠিন কাজ ছিল না, কিন্তু দল তাহার প্রয়োজন আছে বলিয়াই মনে করে নাই। শুধু তাহা নহে, মনমোহন সিংহকে অসমের ‘ঠিকানা’ হইতে রাজ্যসভায় আনিবার বন্দোবস্ত করিয়াছে। ইহাতে প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা বাড়ে নাই, গণতন্ত্রেরও নয়। আক্ষেপের কথা, মনমোহন সিংহ নিজেও, আরও বিবিধ অনৈতিকতার মতোই, এই অনৈতিকতাকে দিব্য হজম করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্বের দশ বছর সম্পূর্ণ হইয়াছে, তিনি মেয়াদের দৌড়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় হইয়াছেন, কিন্তু মর্যাদার দৌড় স্বতন্ত্র।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy