Advertisement
০২ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ন্যাড়া ও ডেসিবেলতলা

আদিকাল থেকে মানুষ শব্দ করে মজা পায়। নইলে শিঙা, দুন্দুভি পসার পেল কেন? দুর্গাপুজোয় দমাস দমাস করে ঢাক পেটানো হয় কেন? আওয়াজ করা যদি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ধুমধাড়াক্কা না-ই হবে, রিপাবলিক ডে-তে রাশি রাশি লোক ড্রাম পেটাতে পেটাতে যায় কেন? প্রেমিকা অবধি প্রেমিকের কানের গোড়ায় জোরসে কু দিয়ে দেয়। আরে বাবা, মুনিঋষিরা বলেন, পৃথিবীতে একটা অনাহত নাদ একনাগাড়ে বেজে চলেছে, থামছে না, থামবেও না।

শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

আদিকাল থেকে মানুষ শব্দ করে মজা পায়। নইলে শিঙা, দুন্দুভি পসার পেল কেন? দুর্গাপুজোয় দমাস দমাস করে ঢাক পেটানো হয় কেন? আওয়াজ করা যদি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ধুমধাড়াক্কা না-ই হবে, রিপাবলিক ডে-তে রাশি রাশি লোক ড্রাম পেটাতে পেটাতে যায় কেন? প্রেমিকা অবধি প্রেমিকের কানের গোড়ায় জোরসে কু দিয়ে দেয়। আরে বাবা, মুনিঋষিরা বলেন, পৃথিবীতে একটা অনাহত নাদ একনাগাড়ে বেজে চলেছে, থামছে না, থামবেও না। সেটা আমরা শুনতে পাই না আমাদের কান সেই অলৌকিক ফ্রিকোয়েন্সি ধরতে পারে না বলে, সেই জন্যেই তো আরও ‘আহত নাদ’-এর ব্যবস্থা দরকার। ভগবানকে চোখে দেখতে পাই না বলেই তার সাতশো রকম মূর্তি গড়ার প্রয়োজন যে রকম, মহাবিশ্বের তন্ত্রীতে কোথায় কোন পিড়িং পিড়িং হচ্ছে তার আন্দাজ পেতেই আমাদের ডেসিবেল চড়িয়ে যেতে হবে।

কালীপুজোয় যে সাংঘাতিক শব্দ করে লোকের পিলে চমকে দেওয়ার মহান ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে, সে তো এমনি এমনি নয়। বেদ বেদান্ত তন্ত্র মন্ত্র সব্বাই বলছে, লাখখানেক চকলেট বোম ফাটাও, কালীপটকা হাঁড়ির মধ্যে ভরে বেরিয়ে থাকা সলতেটিতে আগুন দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে মিচকি মিচকি হাসতে থাকো। পাড়াসুদ্ধু লোকের হার্ট সমারসল্ট খেয়ে আঁতকাবে, আর জগজ্জননীর মহিমাকেত্তন হবে। বছরের অন্য দিনগুলোতেও এই পবিত্র শিক্ষা আমাদের ন্যাজে ন্যাজে চলেছে: সুযোগ পেলেই শব্দ করো। অন্যকে ডিসটার্ব করা তোমার জন্মগত অধিকার। নিজে আনন্দ পাও, তাতে অন্যকে ডিসটার্ব করো, সে রেগে গেছে বলে আরও আনন্দ পাও, এই তো ফর্মুলা। বিদেশিরাও তো পয়লা জানুয়ারি বেদম বাজি ফাটায়। যদি শব্দ আমাদের উৎসবের আবশ্যিক উপাদান না হত, তা হলে তো বাজিতে শুধু আলোর কেরদানিই থাকত। আনাড়ি মানুষ ভাবে, তার ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট চোখ, কিন্তু আসলি হচ্ছে কান। শিশু কি মায়ের চোখে চোখ রেখে ইশারা করে? তিনতলার সমান হাঁ করে চেঁচিয়ে ফাটিয়ে দেয়। তখন মা উঠিপড়ি দৌড়ে আসে, দুধ দেয়। সাধে কি মহাভারতের রিয়েল হিরোর নাম ‘কর্ণ’?

ভাসানের সময় আমরা শব্দ করেছিলাম, তাই পার্থ ঘোষ গৌরী ঘোষের খারাপ লেগেছে। তা এত লোকের অ্যাদ্দিন খারাপ লাগল, কেউ প্রতিবাদ করতে এলে মেরে বিছিয়ে দিলাম, সত্তর বছরের বুড়ির কোমর ভেঙে দিলাম, তখন তো খবরকাগজের টনক নড়েনি! আজ মিডিয়া এমন করে খবর করছে যেন ওঁদের কানে তালা লাগলে বাংলা সংস্কিতি তার চাবি খুঁজতে হন্যে হয়ে যাবে! আরে, ‘ঘোষ’ মানেই তো শব্দ, এঁরা জানেন না? এঁরা কী করেন? না, আবৃত্তি। আবৃত্তি কি এক রকমের শব্দ করা নয়? ওঁরা জোরে জোরে আবৃত্তি করলে যদি আমার ডিসটার্ব হয়, টানা টানা সুরে রবি ঠাকুরের মিনমিনে পদ্যগুলো শুনলে যদি আমার গায়ে বিছুটি লাগে, তবে ওঁরা কি তা বন্ধ করবেন? মানে, যদি ফাংশনের সময় উঠে বলি, মাসিমা-মেসোমশাই, হেভি বোর লাগছে, এত স্যাংস্ক্রিট মার্কা শব্দ আর টেবিলের পায়া ঢাকা দেওয়া মার্কা শালীনতা দেখলে আমাদের হাসি পায় বিরক্তি ওঠে, তবে কি তাঁরা বই গুটিয়ে ‘সরি’ বলে ক্ষ্যামা দেবেন? না কি, তখন আমাদেরই রুচিহীন লোফার বলে ঘাড়ধাক্কা দেওয়া হবে? তাইলে বাবা, যখন আমরা আমাদের মতো করে আমোদ খুঁজে নেব, তোমার গায়ে ফোসকা পড়লেও তুমি তা চেপেচুপে বসে থাকবে না কেন? পৃথিবীতে ম্যাদামারা ভদ্দরলোকের যেমন নিজের মতো করে আনন্দ পাওয়ার অধিকার আছে, বোদা গামবাট লোকেরও তাদের মতো করে আনন্দ পাওয়ার অধিকার আছে। এ বার তুমি বলবে, বাছা, শ্রুতিনাটক করলে তো এত শব্দ হয় না, তুমি লিমিট পেরিয়ে যাচ্ছ, আমার কানের পরদা টাটাচ্ছে। মুশকিল, তোমার আনন্দের ফর্মটাই যেমন সোবার, শান্ত, লো-ভল্যুম, আমার আনন্দের ফর্মটাই যে উচ্চণ্ড, গাঁকগাঁক, হুলুম-হালুম! তুমি তো ক্যাবারে ড্যান্সকে ভরনাট্যমের কুঠুরিতে ঠুসে দিতে পারো না! সালভাদর দালি-র ছবিকে নন্দলাল বসুর ঘরানায় লাবণ্য-ওপচানো হওয়ার বরাত দেওয়া যায় কি? পৃথিবীতে মিঠেও আছে, কড়াও আছে। এই দুনিয়ায় সকল ভাল, চাখতে জানতে হয়। সবার চেয়ে ভাল অবশ্য পাঁউরুটি আর হানি সিং। কিন্তু সে থাক, ঝিংচ্যাক তত্ত্ব বলি।

সমাজের বেহ্ম টাইপ লোকেরা সাবঅল্টার্নদের চিরকাল দুচ্ছাই করে। সাবঅল্টার্নরাও তাই মোক্ষম পাটকেল তৈরি করেছে। শব্দব্রহ্ম। গাঁতিয়ে স্পিকার বাজাও। রোজ। আজ তারকেশ্বরের বাঁক ঝোলালুম, কাল পাবলিক ইউরিনাল উদ্বোধন হল, পরশু ট্যাঁপার হ্যাপি বাড্ডে। ছাড়ব কেন? কেউ কখনও সম্মিলিত ভাবে অন্যকে হ্যারাস করার সুযোগ ছাড়তে পারে? অন্যকে ধামসাচ্ছি, কিন্তু সে কিছুটি বলতে পারছে না, এর চেয়ে বড় অর্গ্যাজ্ম হয়? পুলিশ সাধারণ মানুষকে হ্যারাস করছে, নেতারা মিটিং ডেকে মাইল মাইল জ্যামে সব্বার গাড়ি ফাঁসিয়ে মজা মারছে, নার্সিং হোম রোগীকে চুষে ছিবড়ে করে ফুটপাতে ফেলে দিচ্ছে। আমরা তোমাদের কান মুলছি। নবারুণ বেঁচে থাকলে আমাদের সেরা ফ্যাতাড়ু বলে গ্লোরিফাই করে দিতেন। হে মামলেটের ওপর বিপ্লব ছিটিয়ে ব্রেকফাস্ট করা বাঙালি, মনে রেখো, আমাদের ভাসান-মস্তি শুধু মস্তি নয়, তোমাদের আনন্দ-ধারণার গালে রেকারিং থাপ্পড়। তোমরা আর্টে সেমিনারে সাবঅল্টার্নদের মাথায় তুলে নাচবে, আর জানলার কাচ ভাঙলে পুলিশে কমপ্লেন করবে, হয়? আমরা দিনে দিনে বাড়ছি, তোমাদের মধ্যেও আমাদের জার্ম ঢুকেছে বিস্তর, অলরেডি শেক্সপিয়র থেকে সেক্স-পেয়ারের দিকে দাঁড়িপাল্লা হেলে ঠং, এমন দিন দূরে নয়, যখন ভাসানে টেগোর-কাব্যি মেগা-চিক্কুর ছেড়ে পরিবেসোন, সঙ্গে ধাকচাক ধাকচাক ডি.জে। কাগজে তখন শব্দজব্দ-র মানেই আলাদা!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial anandabazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE