Advertisement
০৩ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১...

নারীমুক্তির কথা বলার দরকার হয়নি

ইমা কেইথেল। মায়েদের বাজার। মেয়েদের বাজার। মণিপুরের এই প্রতিষ্ঠানটি মেয়েদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতার এক অনন্য ভিত। আজ সেই সম্পদ বিপন্ন।খোয়াইরিমবান্ধ বাজার প্রতি দিনই দু’বার প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। এক বার সেই ভোরবেলা। পুব আকাশটা ভাল করে লালই হয়নি, ইমারা আসতে শুরু করেন। আর এক বার যখন সূর্যের শেষ আলো নেমে আসে বাজারের গায়ে। দু’বারের ছবি প্রায় একই। তফাত শুধু পসরা সাজানো আর পসরা গোটানো।

শিল্পী: সুমন চৌধুরী

শিল্পী: সুমন চৌধুরী

সুপর্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া
শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৪ ০৪:৩০
Share: Save:

খোয়াইরিমবান্ধ বাজার প্রতি দিনই দু’বার প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। এক বার সেই ভোরবেলা। পুব আকাশটা ভাল করে লালই হয়নি, ইমারা আসতে শুরু করেন। আর এক বার যখন সূর্যের শেষ আলো নেমে আসে বাজারের গায়ে। দু’বারের ছবি প্রায় একই। তফাত শুধু পসরা সাজানো আর পসরা গোটানো। বেশির ভাগ ইমার কপালে আঁকা লম্বা চন্দনের তিলক। পরনে ফানেক আর ইনাফি। দেখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না, তাঁরা মিতেই কৌমের মহিলা। খুব ভোরে তাঁরা বাসিখউ, জিরিবাম, আন্দ্রো বা অন্য গ্রাম থেকে ইম্ফলের এই বাজারে আসেন। বড় বড় জিপ, অটো রিকশা, আবার গরুর গাড়িতেও বোঝাই করে আনেন নিজের নিজের পণ্যসামগ্রী: নানান সব্জি, শুঁটকি মাছ, মাটির হাঁড়ি, কলসি, জামাকাপড়। খোয়াইরিমবান্ধবাজার, মইনুবাজার ইম্ফল শহরের বুকে সব থেকে বড় বাজার। মণিপুরি ভাষায় ‘ইমা কেইথেল’। মণিপুরি ভাষায় ইমা-র অর্থ মা। মায়েদের বাজার। বাইরে থেকে মানুষ এ রাজ্যে বেড়াতে এলে, অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থানের সঙ্গে, এই বাজার দেখতেও ঢোকেন। কেইথেলের সব বিক্রেতাই মহিলা। বাজারটা পরিচালনা করেন তাঁরাই।
বহু দিন আগে, মণিপুরে মানুষের মুখে-মুখে শোনা যেত একটাই কথা: যে পুরুষ নিয়মিত রাজদরবারে যায় না, আর যে মহিলা বাজারে যায় না, দু’জনেই অকাজের মানুষ। মণিপুরের ইতিহাসে আলাদা ভাবে নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রয়োজন হয়নি। ইমা কেইথেলের জন্মের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছে স্বতন্ত্র চিন্তা। কেইথেলগুলো কখনওই শুধুমাত্র কেনা-বেচার কেন্দ্রস্থল ছিল না। তৈরিই হয়েছিল স্থানীয় বৃত্তে সংবাদ বিনিময়ের কেন্দ্র হিসেবে। সেখানে বিভিন্ন গ্রামের মানুষের নানা খবরাখবর নিয়ে রাজপরিবার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা হত। কোনও বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজা বিচার বসাতে চাইলে কেইথেলেই বসাতেন, সাধারণ মানুষকে শাস্তি দিতে হলেও সেখানেই পাঁচজনের সামনে শাস্তি দেওয়া হত। কেইথেলের ইমাদের ভূমিকা ছিল স্থানীয় সংবাদকর্মীর। তাঁরা নিজের নিজের গ্রামের খবরাখবর কেইথেলে এসে রাজার কানে তুলে দিতেন। কিন্তু রাজার কোনও সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে সঙ্গে সঙ্গে কেইথেলের মহিলারা একজোট হয়ে প্রতিবাদ করতেন। কেইথেল বন্ধ হয়ে যেত। বেশ কয়েক দিন তাঁরা কেইথেলে আসতেন না। ইমাদের সেই প্রতিবাদকে বলা হত ‘কেইথেল কেইবা’। এই প্রতিবাদের মধ্যে দিয়েই ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে মায়েদের এই বাজার।
১৮৯১ সালে ইংরেজ মণিপুর দখল করে নেয়। ১৯০৪ সালে ব্রিটিশ পলিটিকাল এজেন্টের বাসভবনটি কিছু সরকার-বিরোধী মানুষ পুড়িয়ে দেয়। পলিটিকাল এজেন্ট মেজর ম্যাক্রয়াল ওই বাসভবনটি নতুন করে তৈরির কাজে মণিপুরিদের বিনা পারিশ্রমিকে বাধ্যতামূলক শ্রমদানের নির্দেশ দেন। হাজার-হাজার মহিলা সমবেত হয়ে ওই নির্দেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানান। ব্রিটিশ ফৌজ দিয়ে মহিলাদের দমন করার চেষ্টা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ম্যাক্রয়ালকে ওই নির্দেশ প্রত্যাহার করতে হয়। মণিপুরি মহিলাদের সে দিনের সেই সংগ্রাম ছিল প্রথম ‘নুপিলান’। মেয়েদের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কেইথেলের সামনেই। এর পর ১৯২৫ সালে দ্বিতীয় ‘নুপিলান’। সরকারের জলকর বসানোর বিরুদ্ধে। ১৯৩৯ সালে মণিপুরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। সেই ইমা কেইথেল থেকেই ডাক আসে, খোয়াইরিমবান্ধ বাজারের মহিলা বিক্রেতারা রাজদরবার চলাকালীন সেখানে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। দরবারের সদস্যরা পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলেও, সভাপতিকে আটকে ঘেরাও করে মহিলারা তাঁকে টেলিগ্রাফ অফিসে নিয়ে যান। মণিপুরের চাল অন্যত্র রফতানি করার আদেশ রদ না করা পর্যন্ত সভাপতি ও চতুর্থ রাইফল্স-এর কমান্ডান্টকে ঘেরাও করে রাখার সিদ্ধান্ত নেন মহিলারা। সরকার সেনা নামায়। একুশ জন মহিলা গুরুতর আহত হয়েছিলেন। বহু মহিলা সে রাতে চাল-বোঝাই লরির সামনে রাস্তায় শুয়ে পড়েন। মণিপুরের সব চাইতে বড় চাল-কলের সামনে মাঝরাতে দশ হাজার মহিলা মিছিল করে জড়ো হন। দেড় বছর চলেছিল মহিলাদের সেই আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত সরকার চাল রফতানির আদেশ বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
যে কোনও ধরনের সংগ্রামে বা সামাজিক সংকট দেখা দিলে ইমা কেইথেলের মহিলারা নিজেরা মধ্যে মিটিং করেন। যিনি প্রধান পসারিনি, তিনিই পান নেত্রীর মর্যাদা। কেইথেলের নেত্রী হয়েই থাকেন না, মণিপুরি মহিলাদের যে-কোনও সংগ্রামের নেত্রী হয়ে যান। ২০০০ সালের ২ নভেম্বর ইম্ফলের মালোম শহরে অসম রাইফেল দশ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। মৃতদের মধ্যে বাষট্টি বছরের বৃদ্ধা ও আঠারো বছরের যুবতীও ছিল। সেই খবর পেয়ে ইরম শর্মিলা চানু প্রায় ৩০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে নিজের গ্রাম লেইকেই কংখাম থেকে কেইথেলে পৌঁছে যান। ইমাদের সঙ্গে কথা বলেন। সে দিন রাতে বাড়ি ফিরে নিজের মা’কে প্রণাম করে অনশনের অনুমতি নেন। ওঁর সেই সংগ্রাম আজও চলেছে।
২০০৪ সালের ১০ জুলাই ইম্ফল শহরের কাছেই বামন কাম্পু মাধা লেইকাই গ্রামের মেয়ে থাউজাম মনোরমাকে অসম রাইফেল্সের ১৭ নম্বর ব্যাটেলিয়নের কয়েক জন সৈন্য বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পরের দিন মনোরমার বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহ তাঁর বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটি টিলার নীচে পাওয়া যায়। ওঁকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল। সে দিন বিকেল থেকেই ইমা কেইথেলে মায়েরা জোট বাঁধেন। এক হাতে মশাল আর অন্য হাতে বস্ত্র তৈরির ‘তেম’ নিয়ে তাঁরা কয়েকশো জন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ জানান। সমস্ত ইমা কেইথেল বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ জুলাই ইম্ফলের কাংলা দুর্গে অসম রাইফেলস-এর সদর দফতরের সামনে বারো জন মহিলা ঐতিহাসিক নগ্ন-বিক্ষোভ জানান। ওঁরা সকলেই ছিলেন ইমা কেইথেলের দীর্ঘ দিনের প্রাজ্ঞ পসারিণী। তাঁদের হাতে ছিল ব্যানার লেখা ‘ভারতীয় সেনা আমাদের ধর্ষণ করো, আমাদের হত্যা করো। আমরা প্রত্যেকে মনোরমার মা’। দুর্গের ভেতরে অসম রাইফেলসের সেনারা ভয়ে কেঁপে ওঠে। সে দিনের ইমাদের সেই বিক্ষোভ কর্মসূচি শুধুমাত্র মণিপুর কিংবা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তেই নয়, সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু এখন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহিলা-পরিচালিত বাজারের গল্প ক্রমশ অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে। অনেকেরই আশঙ্কা, হয়তো-বা এক দিন ইমা কেইথেল থাকবে না। মুক্ত বাজারের হাওয়ায় ধ্বংস হবে কৌম জীবনের ধারাবাহিকতা। খোয়াইরিমবান্ধ বাজার, মইনু বাজারের মতো বড়-বড় কেইথেলগুলোতে আগে দূরদূরান্তের মহিলারা আসতেন। এখন সেখানে স্থায়ী ভাবে জায়গা পাওয়া মুশকিল হচ্ছে। কেউ বলছেন, ইম্ফল ইমারা এতটাই শক্তিশালী যে, তাঁরা ঠিক করেন কে হবে স্থায়ী বাজারের স্থায়ী পসারিনি। ইমাদের মধ্যে এক ধরনের শ্রেণিভেদ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির লম্বা হাতই এই শ্রেণিবৈষম্যের বীজ প্রোথিত করছে বলে ভাবছেন অনেকেই। এত দিন পর্যন্ত ইমারা নিজেদের শ্রেণি বা সামাজিক পরিচয়কে দূরে সরিয়ে রেখে কেইথেলে আসতেন। সেখানে এক জন ডাক্তারের মা, পুলিশ অফিসারের মা, আবার হয়তো সশস্ত্র জঙ্গির মা-ও শুধুমাত্র ইমা পরিচয় নিয়ে, পসারিনি হয়ে বসতেন। তাঁরা যে ইমা, ইচা, ইদোমচা (মা, কাকিমা, মাসি), সেটাই ছিল মূল পরিচয়। নিজের নিজের শ্রম দিয়ে উৎপন্ন পণ্য বাজারে নিয়ে এসে তাঁরা বিক্রি করেন ও মণিপুরের কৌম সমাজের একটি ধারাবাহিকতাকে বয়ে নিয়ে চলেন, সেটাই ছিল শেষ কথা।
এত দিন নিয়ম ছিল, কেইথেলের এক জন বয়স্কা ইমা অক্ষম হয়ে গেলে তাঁর মেয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে বসতেন। ইমাদের মূল পসারিনিদের বয়স হত চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ। এখন ইম্ফল শহরের মূল স্থায়ী কেইথেল পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পড়াশোনা-জানা কমবয়সি মেয়েরা ধারাবাহিক ভাবে আগের মতো ইমা হতে চাইছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, কিংবা বাইরে পড়াশোনা করতে চলে যাচ্ছে, এমন মেয়েরা কি পড়া শেষ করে এসে ইম্ফলের কেইথেলের পসারিনি হবে? পাশাপাশি কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ছোট-ছোট অস্থায়ী কেইথেলগুলো বড় হচ্ছে। তাতে অনেক ছোট-ছোট মেয়েকেই দেখা যাচ্ছে। গ্রামের মেয়েরা পড়াশোনার চেয়ে কেইথেলে গিয়ে বসাই লাভজনক মনে করছে।
মেইরা পাইবি সংগঠনের এক নেত্রীর বক্তব্য, ‘আসলে ইমা কেইথেলকে ভেঙে দেওয়ার একটা চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। আগে ইমারা নিজেরা হাতে তৈরি আচার, চাটনি, জেলি নিয়ে কেইথেলে আসত। এখন সে সব ইম্ফলের চোরাবাজারে পাওয়া যাচ্ছে।’ ইম্ফল থেকে মাত্র দেড়শো কিলোমিটার দূরে মোরে অঞ্চল। সেই অঞ্চল দিয়ে তাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চিনের বহু পণ্যসামগ্রী চলে আসছে মণিপুরের বাজারে। দামও কম।
বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সবল হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া, ঘন-ঘন বন্ধ, কারফিউ, পথ অবরোধ এ সবও দায়ী। পাশাপাশি এক শ্রেণির ছেলেরা চান, তাঁদের স্ত্রীরা ঘরে বসে কাপড় তৈরি করুক, কেইথেলের ইমারা এসে তা নিয়ে যান বাজারে। কেইথেলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হয়ে, বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ করাই তাঁদের পছন্দ।
মণিপুরে রেললাইন তৈরি হচ্ছে। রাস্তা চওড়া হচ্ছে। উন্নয়নের পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা চলেছে। নানা ধরনের ফেস্টিভ্যাল, ফ্যাশন শো, ট্রেড ফেয়ারের আয়োজন করা হচ্ছে। ইমা কেইথেলেও জায়গা করে নিচ্ছে আমদানি করা পণ্যসামগ্রী। স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে কৌম সমাজের শিকড়টা ধরে রাখার চেষ্টাই দুর্বল হতে বসেছে। অনেকেই চিন্তিত। তাঁরা ভাবছেন, তবে কি কর্পোরেটাইজেশনের ঝোড়ো হাওয়ায় হারিয়ে যাবে কেইথেলের ঐতিহ্য? তার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাবে মণিপুরি মহিলাদের সংগ্রামের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE