মদ্যপান নিষিদ্ধ করিতে কেরল সরকারের নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ দিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। পাঁচ-তারা নয়, এমন হোটেলগুলিতে মদ্যপান বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছিল সরকার। শীর্ষ আদালতের বক্তব্য, এ ভাবে বিত্তবানদের জন্য মদ্যপানের অনুমতি মঞ্জুর করিয়া নিম্নবিত্তদের জন্য তাহা নিষিদ্ধ করা যায় না। কেননা তাহা বৈষম্যের শামিল। সঙ্গত এবং ন্যায্য মন্তব্য। কেরল সরকারের হইয়া সওয়ালকারী আইনজীবী অবশ্য জানাইয়াছেন, দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারে মদ্যপান গুরুতর আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও সঙ্কট ঘনাইয়া আনে, যাহা উচ্চবিত্তদের ক্ষেত্রে ঘটে না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা সেই অজুহাত গ্রাহ্য করেন নাই, চলতি মাসের শেষ পর্যন্ত মদবিক্রয়কারী হোটেল-রেস্তোরাঁগুলি আগের মতো খোলা রাখার নির্দেশ দিয়াছেন।
কিন্তু এই নির্দেশের সূত্রেই বৃহত্তর প্রশ্নটি উঠিতে বাধ্য। মদ্যপানের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের যুক্তি কী? প্রথম কথা, এই নিয়ন্ত্রণ বাস্তবে কতটুকু কাজ করে? দেশের যে-সব রাজ্যে এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রহিয়াছে সেই সব রাজ্যে কি মদ পাওয়া যায় না? অবশ্যই যায়, তবে চোরাপথে। কালোবাজার হইতে ক্রয় করার ফলে সেই পানীয়ের দাম যেমন বেশি পড়ে, তেমনই অল্প দামের পানীয়ের ক্ষেত্রে তাহার গুণগত মানও অনিশ্চিত হইয়া পড়ে। আর তাহাতেই মদ সেবনকারীরা বিষমদের পাল্লায় পড়েন, অসুস্থ হন, এমনকী মারাও যান। তা ছাড়া, নেশা করার বিকল্প পানীয় হিসাবে বিভিন্ন কাশির সিরাপ, ডেনড্রাইট, এমনকী ডেটলের মতো জিনিসও মরিয়া নেশাকারীরা ব্যবহার করিতে থাকেন। তাহাতে স্বাস্থ্যহানি ও শারীরিক বিপর্যয়ের শঙ্কা মদের তুলনায় অনেক বেশি। কোনও কোনও অঞ্চলে মদ্যপায়ীরা ঠাণ্ডা পানীয়ের সহিত ‘আয়ুর্বেদিক’ নানা ঔষধ মিশাইয়া বিপজ্জনক মাদক তৈয়ার করিয়া সেবন করেন।
দ্বিতীয় কথা, মদ্যপানের উপর রাষ্ট্রের কোনও নিয়ন্ত্রণের যুক্তিই বা কী? ভারতীয় আদর্শের দোহাই পাড়িয়া এ ক্ষেত্রে কোনও লাভ নাই। সনাতন ভারতে, বৈদিক যুগে, মদ্যপানের ব্যাপক চল ছিল। সোমরস পানে কোনও নিষেধাজ্ঞা কখনও ছিল না, বরং যাগযজ্ঞে তাহার ব্যাপক ব্যবহার আবশ্যিক ছিল। মহিষাসুর বধের প্রাক্কালে দুর্গতিনাশিনীও ‘মধু’ পান করিতে করিতে দানবরাজকে ভর্ৎসনা করিয়া অতঃপর তাহার মস্তক ছেদন করেন, হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় কোনও নারীর পক্ষে কোনও বীর ও যোদ্ধা পুরুষকে হত্যা করা সম্ভব ছিল না বলিয়াই। এই মধু আসলে আসব অর্থাৎ মদ্য, যাহার পানে সনাতন ভারত কোনও বিষম দোষ দেখে নাই। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী এই একবিংশ শতকে সহসা কেন মহাত্মা গাঁধী ও বিনোবা ভাবের আত্মসংযমের নীতিতে রাজ্যবাসীকে বাধ্যতামূলক ভাবে দীক্ষিত করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন, বুঝা দুষ্কর। গণতন্ত্রে পছন্দের অধিকারের যে স্বীকৃতি শিরোধার্য, তিনি কি তাহা অনুমোদন করিতে কৃপণ? মদ্যপানে যদি কোনও পরিবারের স্থিতি, শৃঙ্খলা ও নিশ্চিন্তি ক্ষুণ্ণ হয়, তবে সেটা সেই পরিবারের সমস্যা। প্রতিটি পরিবারে তেমন অশান্তি দেখা দিলে সেটা সমাজের সমস্যা হইয়া দাঁড়ায়। সামাজিক স্তরে তাহার মোকাবিলা করা, মদের নেশার ‘কুফল’ লইয়া আলাপ-আলোচনা, জনচেতনা জাগ্রত করা, এমনকী আন্দোলন করাও চলিতে পারে। কিন্তু কাহারও মদ্যপানের অধিকার খর্ব করার এক্তিয়ার সরকার কিংবা রাষ্ট্র প্রয়োগ করিবে কেন? রাষ্ট্রের কাজগুলি রাষ্ট্র যথাযথ ভাবে পালন করুক। অনধিকার চর্চার প্রয়োজন নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy