রবীন্দ্রনাথ তখন নিতান্ত কিশোর। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শহর কলকাতা। ইংরেজরা দেশের শাসক। ক্রমে খেতে-পরতে পাওয়া ভদ্রলোক বাঙালির দেশোদ্ধারের ইচ্ছে জাগছে। সেই ইচ্ছেকে পরিতৃপ্ত করার কিছু একটা উপায় চাই। নেশনের কথা বলা আর ন্যাশনালের ধুয়ো তোলা তখন নতুন ফ্যাশন। তাতে দেশের আমজনতার খাওয়া-পরার গতিক কিছু না বদলাক, শাসকদের প্রশাসন যন্ত্রের একটা স্ক্রুও ঢিলে না হোক, ভদ্রলোকদের দিব্যি আত্মতৃপ্তি হত। ঠনঠনের গলিতে এক পোড়ো বাড়িতে দেশোদ্ধারের জন্য গোপন সভা বসত, কিশোর রবীন্দ্রনাথ সহ অনেকেই সেখানে জমায়েত হতেন। সভার একটি সাংকেতিক নাম ছিল: ‘হা ম চু পা মু হা ফ’। রবীন্দ্রনাথ পরিণত বয়সে তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে সেই সভাকাণ্ডের মূল্যায়ন করেছিলেন। নির্মোহ আত্মসমালোচনা করতে একটুও দ্বিধা করেননি। গোপন সভার মাধ্যমে পরাধীন ইংরেজ শাসনাধীন বঙ্গদেশের কোনও উপকারই হত না। ফোর্ট উইলিয়ামের একটা ইটও সেই সভার বসা-ওঠায় খসেনি। তবে সভাসদরা চুপিচুপি দেশের উন্নতি করছি ভেবে ও এই স্বাদেশিক প্রহসনে অভিনয় করে খুবই খুশি হতেন। ‘সকলের রোমহর্ষণ’ হত। আর বেশি কিছুর প্রয়োজন তাঁদের ছিল না। আত্মতৃপ্তি, আহা কী করছি ভেবে অহং-এর পুষ্টি। ব্যস। আর কী চাই? রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের সেই স্বাদেশিক স্মৃতি সম্বন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমাদের প্রধান কাজ উত্তেজনার আগুন পোহানো।’
রবীন্দ্রনাথের কাল অতীত। দেশ দ্বিখণ্ডিত ও স্বাধীন হয়েছে। তা সে-ও অনেক দিন হয়ে গেল। এখন মোটামুটি মূলধারার রাজনীতি করলে ও সেই রাজনীতি বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত দিতে ইচ্ছে করলে আর গলির মধ্যে পোড়োবাড়িতে ঢুকতে হয় না। ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশ। প্রকাশ্যেই তাই কথা বলা চলে। কেবল রাষ্ট্র যাদের ‘জঙ্গি সংগঠন’ হিসেবে দাগিয়ে দেয় তাদের কথা একটু আলাদা, রহস্যে আবৃত থেকেই তাদের দেশের জন্য ‘অনুষ্ঠান’ করতে হয়। গামছায় মুখ ঢাকতে হয়।
যাক সে কথা। আমরা যারা নিজের উপার্জনে বা পৈতৃক অর্থে মোটামুটি খেতে পরতে পাই, খুচখাচ রাজনীতি করি কিংবা ভাবি ও সন্ধেবেলা ঘরে বসে টিভি দেখে থাকি, তাদের জীবন ইদানীং আবার খোলামেলা রাজনৈতিক তরজা দেখাশোনায় বর্ণময় হয়ে উঠেছে, কারণ ভোট আসছে। বৃহত্তম গণতন্ত্রে লোকসভা নির্বাচন বলে কথা। স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচনে কংগ্রেস যে বিপুল ভোট পেয়েছিল তা তো সুদূর অতীত। সর্বভারতীয় বড় দল নয়, ক্রমশই ছোট, মেজো স্থানীয় দলগুলি ভারতীয় গণতন্ত্রের জোট রাজনীতিতে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ফলে তরজায় নানা স্থানীয় চেহারা ও মুখ আবশ্যক। পশ্চিমবঙ্গই বা বাদ যায় কেন! তরজার এই স্থানীয় ময়দানে তাই নানা জন মুখ দেখাচ্ছেন। সেই সব বাঙালির কেউ কবি, কেউ শিল্পী, কেউ চলচ্চিত্রাভিনেতা, কেউ আরও কিছু কিছু। তাঁদের আবার পক্ষ বদল চলছে। পক্ষ বদলের খবর দিতে সাংবাদিক সম্মেলনও হচ্ছে। তাই নিয়ে সন্ধেবেলার টিভিতে কথা ও বার্তার খই ফুটছে। কোন ব্যক্তিগত বেদনার সময় কোন রাজনৈতিক দলের কে কার কাছে এসেছিলেন বা আসেননি, তার প্রসঙ্গ পাক খাচ্ছে। অফিস থেকে ফিরে টিভির সামনে আমরাও বসে পড়ছি। আমরাও বেশ দেখছি, ওঁরাও বেশ দেখাচ্ছেন। আমরা ভাবছি, আহা আমরা কী রাজনীতিসচেতন প্রখর সভ্য নাগরিক, আর টিভির পর্দার ভেতরের মানুষরা ভাবছেন তাঁরা কী দায়বদ্ধ মহান কেউকেটা। এতে আমরা যারা মোটামুটি নিরাপদে থাকা ‘দেখছি’ ও ‘দেখাচ্ছি’ শ্রেণির লোক, তার বাইরে সাধারণ মানুষের অবশ্য কিছু যাচ্ছে-আসছে না। আমরাই শুধু বেশ বিনোদনমূলক পারস্পরিকতায় স-উত্তেজনা রাজনীতিসচেতনতার জাবর কাটছি। বলতে ইচ্ছে করছে, ‘হা ম চু পা মু হা ফ’-এর সদস্যদের মতো আমাদেরও এখন প্রধান কাজ উত্তেজনার আগুন পোহানো। পার্থক্য শুধু এই, তাঁদের ছিল গলির মধ্যে পোড়ো বাড়ি আর আমাদের আছে ঘরে ঘরে অজস্র টাটকা চ্যানেলওয়ালা ব্যস্ত টিভি, মাথায় পাখা কিংবা এসি।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য শুধু এই উত্তেজনা পোহানো স্বদেশিদের কথাই লেখেননি। তাঁর দীর্ঘ জীবনে নানা কাজ করতে করতে অন্য এক দল মানুষের কথা ভেবেছিলেন। সেই সব অন্য রকমের মানুষের বাস্তব অস্তিত্বও ছিল। তাঁরা দেশের নামে উত্তেজনা পোহাবেন না, কাজ করবেন। দেশ তাঁদের কাছে নেশার ছিলিম নয়, সত্য বস্তু। পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনী বসেছিল ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে। সেখানে সভাপতির অভিভাষণ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন, দেশের কাজ করা, দেশের জন্য ভাবা মানে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মেশা। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নেতা হওয়ার দরকার নেই। সাধারণ মানুষ যাতে নিজেরা সমবেত হয়ে তাদের সমস্ত কর্তব্য নিজেরা করতে পারে সেটুকু দেখা চাই। এ কাজ তো এক দিনে হবে না। লেগে থাকতে হবে। যিনি এই কাজে নামবেন তাঁর আত্মরতি উসকে দেওয়ার কোনও সুযোগ কিন্তু সেখানে থাকবে না। ‘ইহাতে কোনো উত্তেজনা নাই, কোনো বিরোধ নাই, কোনো ঘোষণা নাই, কেবল ধৈর্য এবং প্রেম, নিভৃতে তপস্যা মনের মধ্যে কেবল এই একটিমাত্র পণ যে, ‘দেশের মধ্যে সকলের চেয়ে যাহারা দুঃখী তাহাদের দুঃখের ভাগ লইয়া সেই দুঃখের মূলগত প্রতিকার সাধন করিতে সমস্ত জীবন সমর্পণ করিব।’ কোনও সন্দেহ নেই রবীন্দ্রনাথ গুরুতর দায়িত্বের কথা বলেছিলেন। উত্তেজনা, বিরোধ, ঘোষণা, এ-সব না থাকলে আর কী লাভ! উত্তেজনা, বিরোধ, ঘোষণার আঁচ পোহাতেই তো টিভিতে মুখ দেখানো আর সেই প্রতিফলিত উত্তেজনায় সামনের দর্শকের শরীর মন মশগুল। আহা, ওর মতো কবি, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রীর কথার অনুসরণ বা বিরোধিতা করছি যখন, তখন আমরা দর্শকরাই বা কম কী! আত্মতৃপ্তির ধারা সুরসুরিয়ে বইছে।
যদি এর থেকে একটু বাইরে আসা যেত! রবীন্দ্রনাথের কথা মতো সমস্ত জীবন অর্পণ না হয় না-ই হল, কিন্তু যদি আমরা দৈনন্দিন টিভির সামনে থেকে একটু সরে এসে, বাইরে এসে পারিপার্শ্বিক সমাজ ও পরিবেশের জন্য কিছু অন্তত করতাম। নিদেনপক্ষে ছুটির দিনে নিয়ম করে কোনও দরিদ্র ছেলেমেয়েকে খানিকটা পড়ানো, পাড়ার মানুষদের জুটিয়ে পাড়াটাকে একটু সাফসুতরো রাখা!
লক্ষ করার, রবীন্দ্রনাথ দুঃখের মূলগত প্রতিকার চাইছিলেন, কোনও তাৎক্ষণিক নকশা তাঁর কাম্য ছিল না। এটাও তিনি বারেবারেই বলছিলেন যে, জনসাধারণকে স্বাবলম্বী হতে হবে। এই স্বাবলম্বনে অনুঘটক ও সহায়কের কাজ করতে পারেন সচেতন মানুষরা, কিন্তু সাধারণের কাজ করে দেওয়ার বা ভাবনাটুকু ভেবে দেওয়ার অধিকার এই সচেতন মানুষদের নেই। ছোটবেলায় স্বাদেশিকতার নামে যে গুপ্ত উত্তেজনার আঁচ পোহানোর বহর দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তারই বিপরীতে তাঁর এই ভাবনা। সমাজ গঠনের এই কাজ করার জন্য রাজনৈতিক দল বা মতের তল্পিবাহক হওয়া নিষ্প্রয়োজন।
গণতন্ত্রে যখন সত্যি কোনও সংকট আসে তখন মিডিয়ায় স্পষ্ট করে তার বিরোধিতা করতে পারেন সচেতন নাগরিক। মিডিয়া তো গণতন্ত্রের অন্যতম সহায়ক। নানা মত ও ঘটনার পরিবেশক। এমনকী ক্ষমতাসীন সরকার যাতে কোনও অনাচারকে গোপন করতে না পারেন সে বিষয়েও মিডিয়ার সজাগ থাকা জরুরি। পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রামে, কামদুনিতে যা ঘটেছিল সে-সবই নিন্দা করার মতো, প্রতিবাদ করার মতো ঘটনা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, প্রতি মুহূর্তে উত্তেজনার নেশায় নিজেদের মুখ দেখানোর বাসনায় দেশের নামে চ্যানেল থেকে চ্যানেলে দেশভাবুকেরা বিহার করবেন। তাতে চ্যানেলের লক্ষ্মীলাভ, দেশভাবনার নামে চ্যানেলজীবীদের তাৎক্ষণিক খ্যাতি প্রাপ্তি ও দর্শকদের ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ আমোদ প্রাপ্তি। এর জন্য এত!
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy