Advertisement
০৪ জুন ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

প্রযুক্তির ভূত

মৃত্যু অনিবার্য। মানুষের অমর হইবার বাসনাও কিন্তু কিছু কম নহে। যিনি যে ভাবে পারেন, প্রয়াণের পর যাহাতে চিহ্ন থাকে তাঁহার ব্যবস্থা করিয়া যান। যাঁহার যেরূপ সাধ্য, তাঁহার সেই রূপ আয়োজন। গৃহী মনে করেন সন্তানের মধ্যেই তাঁহার ধারা বাঁচিয়া রহিল, শিল্পী তাঁহার সৃষ্টির মধ্যে ভবিষ্যতে বাঁচিয়া থাকিতে অভিলাষী।

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৪ ০০:১৯
Share: Save:

মৃত্যু অনিবার্য। মানুষের অমর হইবার বাসনাও কিন্তু কিছু কম নহে। যিনি যে ভাবে পারেন, প্রয়াণের পর যাহাতে চিহ্ন থাকে তাঁহার ব্যবস্থা করিয়া যান। যাঁহার যেরূপ সাধ্য, তাঁহার সেই রূপ আয়োজন। গৃহী মনে করেন সন্তানের মধ্যেই তাঁহার ধারা বাঁচিয়া রহিল, শিল্পী তাঁহার সৃষ্টির মধ্যে ভবিষ্যতে বাঁচিয়া থাকিতে অভিলাষী। প্রাচীন কালের সম্রাটদের জন্য সমাধি ও স্মৃতি মন্দিরের ব্যবস্থা ছিল। মিশরের পিরামিড দোর্দণ্ডপ্রতাপ রানি ও ফারাওদের দেহ, বহু মূল্যবান বস্তুসহ ধারণ করিয়া রাখিত। প্রাচীন উদ্যোগের দিন গিয়াছে, কিন্তু অমর হইবার ইচ্ছাটি যায় নাই। আধুনিক প্রযুক্তি অমরতাকে ভিন্নমাত্রা প্রদান করিতে চাহে, এই ইচ্ছাকে ব্যবসা সামগ্রী করিতে চাহে। ইটারনি ডট মি নামের নব্য কোম্পানি প্রযুক্তি সহায়ে মানুষকে আর এক ভাবে বাঁচাইয়া রাখিতে তৎপর। ব্যক্তিমানুষটি জীবৎকালে জীবনের প্রায় সব তথ্যাদি এই কোম্পানিটিকে সরবরাহ করিয়া যাইবেন। ধরিয়া রাখা হইবে ওই ব্যক্তির ছবি ও কণ্ঠস্বর। সেই ব্যক্তির প্রয়াণ ঘটিবার পর এই কোম্পানি যাবতীয় তথ্য সহায়ে, ছবি ও কণ্ঠস্বর ব্যবহার করিয়া রূপময় তথ্যভাণ্ডার নির্মাণ করিবেন। ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু হইল, কিন্তু সেই অশরীরীর বহু কিছু রহিয়া গেল চলমান ব্রহ্মাণ্ডে। তাঁহার কোনও উত্তরপুরুষ যদি কোম্পানির নিকট জানিতে চাহেন পূর্বজের কথা, ভাবিতে চাহেন কোনও বিশেষ পরিস্থিতিতে কী করিতে পারিতেন তাঁহার পূর্বপুরুষ, সঙ্গে সঙ্গে জবাব মিলিবে। ঠিক যেমন গুগ্ল সার্চে মিলিয়া যায় নানা তথ্য, তেমনই ইটারনি ডট মি বাঁচাইয়া রাখিবে পরম্পরা, জিয়াইয়া রাখিবে পারিবারিক ঐতিহ্য, সজীব রাখিবে মৃত ব্যক্তির অধিকারবোধ।

মৃতকে অনন্তকাল টিকাইয়া রাখিবার এই প্রকল্পটি জীবিতদের পক্ষে খুব সুখকর নহে। রবীন্দ্রনাথের ‘কর্তার ভূত’ রচনাটির কথা প্রসঙ্গত মনে পড়িবে। দেশের সবাই কর্তার উপর বিশেষ নির্ভর করিত। কর্তা যখন মরিবেন, তখন দেশের এক দল লোক ভাবিল, তাহাদের চলিবে কী উপায়ে! তখন কর্তাকে ভূত করিয়া অমর করিয়া রাখা হইল। চোখে দেখা যায় না তো কী! কর্তার অমোঘ নিয়মেই দেশ চলে, ভূতের পেয়াদারাই দেশ চালায়। ইহাও যেন খানিক সেই প্রকার। ঐতিহ্য ও পরম্পরার নামে পারিবারিক পুরাতনকে কাঁধে রাখিয়া দেওয়া। যিনি মারা গেলেন তাঁহাকে স্মরণে রাখা এক, আর বহিয়া লইয়া চলা আর এক। হিন্দুরা দাহকার্য সমাপন করিয়া ফিরিয়া আসে, সেই সময় আর ফিরিয়া চাহে না। যিনি গিয়াছেন তাঁহাকে যাইতে দাও। ধরিয়া রাখিয়ো

না, শুধু মনে রাখিয়ো। প্রতি বৎসর তর্পণ সেই স্মরণের অনুষ্ঠান। ইটারনি ডট মি কেবল মনে রাখিতে চাহে না, ধরিয়া রাখিতে চাহে।

আদতে মানবসভ্যতা কিন্তু অনাগরিক। অন্য পশুর ন্যায় গুহাগর্ভের অন্ধকারে জন্মজন্মান্তর ধরিয়া টিকিয়া থাকা এই সভ্যতার উদ্দেশ্য নহে। যে পথে কেহ চলে নাই সে পথে চলিবার, যে কাজ কেহ করে নাই সেই কাজ করিবার উৎসাহে মানবসভ্যতা বলীয়ান। এই অ-বিবেচনাটির গুণেই মানুষ সভ্য হইয়াছে। অতীত ও পরম্পরাকে নির্দেশনামার মতো পিছনে ঝুলাইয়া রাখিবার ব্যবসাটি সভ্যতাকে ভূতগ্রস্ত করিবে, পশ্চাতে টানিবে। ইহার মৌলিক ভ্রান্তিটি এইখানেই যে, ইহা চরিত্রে সভ্যতার বিপ্রতীপ। সুতরাং মানুষের ডিজিটাল জীবনকে অবিনশ্বর করিবার পরিকল্পনাটি অভিনব হইতে পারে, কিন্তু শুভ নহে। প্রযুক্তির ভূত রবীন্দ্রনাথের কর্তার ভূতের ন্যায় পরম্পরার নামে নজরদারি করিবে, স্বাধীনতা খর্ব করিবে। ইহা কখনও কাম্য নহে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE