আমি ঐতিহাসিক নই, কিন্তু ইতিহাস আমাকে ডাকে বড় আদরের সঙ্গে। বঙ্গভূমির রাজনীতি এবং রাজনীতির ইতিহাস অতি বিচিত্র। রাজনীতির সঙ্গে বিজ্ঞানের খুব একটা সংস্পর্শ নেই, এটাই প্রচলিত ধারণা। এই ধারণাটি কিন্তু একেবারেই ভুল। বিজ্ঞানের উৎকর্ষ এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মধ্যে এক নিবিড় সম্বন্ধ রয়েছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোবৃত্তি বিজ্ঞানকে সবল অথবা দুর্বল করতে পারে।
জয়পুরের মহারাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয়সিংহ (১৬৮৮-১৭৪৩) বিজ্ঞানের ভক্ত ছিলেন, বড় মাপের। তাঁরই চেষ্টায় ভারতবর্ষের নানান জায়গায় যন্তরমন্তর বসানো হল, গ্রহ-তারার গতিবিধি বোঝবার জন্যে অ্যাস্ট্রোলোব প্রতিষ্ঠা করা হল। পারস্য থেকে, মেসোপটেমিয়া থেকে, মিশর থেকে গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদরা ভারতবর্ষে এসেছিলেন।
১৭৪৩ সালে মহারাজার আকস্মিক মৃত্যুর পরেই ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে বিজ্ঞানের সূর্য অস্ত গেল, অস্ত গিয়েই থাকল, টানা একশো বছর ধরে। অরাজকতা, ছোট ছোট যুদ্ধ, বাইরে থেকে ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসিরা ব্যবসার লোভে ভারতবর্ষে ঢুকে পড়ল। তৈরি হল উপনিবেশের প্রথম সোপান, বিশেষত বাংলায়। বিজ্ঞান ঘন অন্ধকারে কোথায় হারিয়ে গেল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার মোড় ঘুরল, হুগলি নদীর পূর্বে আর পশ্চিমে নতুন সভ্যতার জাগরণ এল। যে নবজাগরণ, বিশেষত বিজ্ঞানে, সম্ভব হয়েছিল আর্থিক সচ্ছলতার জন্যই। কলকাতায় লন্ডনের তুলনায় জাঁকজমকের কিছু কমতি ছিল না। বিত্তবানদের খেলাঘর তখন কলকাতা, কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি তখন শিখরে। প্রাণ খুলে মানুষ টাকা ঢেলেছিল সেই সময়। একটার পর একটা ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন হতে থাকল। শতকের মাঝামাঝি, ১৮৫৮ সালে বিজ্ঞানের নবজাগরণের প্রাণপুরুষের জন্ম। জগদীশচন্দ্র বসু। টাকার টানাটানি থাকলেও তাঁর পরম বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরার মহারাজার কাছ থেকে এবং অন্যান্য বিত্তবান মানুষের কাছ থেকে টাকার জোগান আনিয়ে দিয়েছিলেন। টানাটানি থাকলেও পর্যাপ্তির কোনও অভাব ছিল না। বিভিন্ন মহলের সম্পন্ন জনেরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত হস্তে দান করেছিলেন। নবজাগরণের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক সচ্ছলতা দেখা দিল।
শুধু বুদ্ধিজীবী নয়, বড় মাপের বিজ্ঞানজীবীর আবির্ভাব হল একের পর এক। তাঁরা পরাধীনতার মধ্যেও স্বাধীন চিত্তের পরিচয় দিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। কলকতায় বসে কাজ করে অধ্যাপক সি ভি রমন নোবেল পেলেন। টাকার অভাব ছিল না। কিন্তু এটাও লক্ষ করতে হবে যে, টাকা টাকা আরও টাকা করে তাঁদের কোনও দিন চেঁচাতে দেখা যায়নি, ব্যবহারিক জগতের সীমাহীন চাহিদার মহাসাগরে তাঁরা ডুব দেননি, পাঁচটা দামি গাড়ি নিয়ে পথেঘাটে ঘোরেননি। সত্যেন বোস বেশির ভাগ সময়েই রিকশা করে গন্তব্যস্থলে যেতেন, তাতে তাঁর সমাদর বিন্দুমাত্র কমেনি। ষাটের দশকের প্রথম দিকেও ওই সংস্কৃতি ভাল ভাবেই বজায় ছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকরা তখনও খুব উঁচু মাপের, এক জন তো জগদ্বিখ্যাত, নিজের নামে ইকোয়েশন আছে মাধ্যাকর্ষণের ওপরে। চোখা চোখা অধ্যাপক, পরে দেখলাম তাঁদের খ্যাতি কেমব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ইংরেজি বা বাংলা ভাষাতেও নাম করা এবং অনুপ্রেরণাকারী অধ্যাপকরা ছিলেন।
উত্তাল তরঙ্গ কিন্তু তখনই কিছুটা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। কী যেন এক মহা আশঙ্কায় ‘সব সংগীত ইঙ্গিতে গেছে থামিয়া’। কিন্তু বিহঙ্গের পাখা অন্ধ, বন্ধ। ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে অন্ধকার নামল। ‘প্রতিক্রিয়াশীল নিপাত যাক’ হুংকারে বাংলার মাটি বাংলার জল পূর্ণ হল, বাঙালির ভাগ্যদেবীর ভাণ্ডার শূন্য হল। রাজনৈতিক খুনখারাবি দৈনন্দিন বাজার-হাটের মতোই হয়ে উঠল। পড়ুয়ারা রাতারাতি দিল্লিমুখো হল পড়াশোনার তাগিদে। যে বাংলায় ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বড় বড় কোম্পানির অফিস ছিল, তারা বেশির ভাগই দিল্লি কিংবা মুম্বই ছুটল নেহাতই বাঁচবার তাড়ায়। বাংলার সরকার কমিউনিজমের ধ্বজা ধরে সব কলকারখানাকে ট্রেড ইউনিয়নের হাতে তুলে দিল। যে একটুখানি শিল্প ছিল, তারাও পালিয়ে বাঁচল। বাংলার দেউলিয়া হবার উপক্রম হল। বাকি যা টাকা ছিল, ক্যাডাররা উজাড় করে খেয়ে নিল। হাত বড় হতে আরম্ভ করল আর পেট মোটা। বাংলা যে সচ্ছলতায় অভ্যস্ত ছিল, সে সচ্ছলতা কয়েক বছরের মধ্যেই উবে গেল। বাংলা নীরবে গরিব হতে থাকল।
পরিষ্কার বোঝা গেল যে, বিজ্ঞানের যে উৎকর্ষ বিংশ শতাব্দীর প্রথমে সারা জগতে নাম কিনেছিল, তা ক্রমশই জীর্ণ, ভগ্নদশার দিকে ছুটে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গ আত্মবিশ্বাস হারাল। বাঙালি খুব অল্প সময়েই কূপমণ্ডূক হল। ভাল ভাল বাঙালি বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্র কিংবা দিল্লি-মুম্বইয়ের দিকে পাড়ি দিলেন। বিজ্ঞানের জগৎ তাসের পাহাড়ের মতন ধসে গেল। যাঁরা টিকে থাকলেন, বেশির ভাগই নিম্নমেধার, অলস। আরও কিছু ধরনের লোক ‘আমাগো লোক’ বলে বড় হলেন। বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ বাঙালির চিরকালই ছিল, সেটাই ধুয়ে কিছু কিছু মেধাবী পড়ুয়া টি আই এফ আর, মুম্বইতে, কিন্তু আরও বেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ছুটল। বাঙালি বাবা-মা’দের ছেলেমেয়েকে আমেরিকা পাঠানো একটা বিশেষ পেশা হয়ে দাঁড়াল।
শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন এল দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর পর। পরিবর্তনের পরে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, যেটা কিনা আমাদের সময় কলেজ ছিল, যে কলেজ নিয়ে আমরা এখনও গর্বিত বোধ করি, সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে সাজিয়ে ঠিক মতো বসাতে সরকার হিমশিম। বিজ্ঞানের তীর্থক্ষেত্র, যেগুলি বিশেষত বাংলা সরকারের দখলে, সবাই বলে উঠল টাকা নেই টাকা নেই। ওই প্রেসিডেন্সি কলেজে আমাদের সময় (১৯৬১-৬৪) বেকার ল্যাবরেটরিতে যা যন্ত্রপাতি ছিল, তার কোনও বিশেষ পরিবর্তন দেখি না আজকের দিনে। অথচ দুনিয়া কোথায় এগিয়ে গেছে! কী করব? টাকা নেই। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রয়েছে এক গভীর নিরাশা। বাঙালির দৃঢ় বিশ্বাস যে কোনওটাই কিছু হবে না। কিছু না হওয়াই এখানকার নিয়ম, কী করে কী হবে? বাঙালি ড্রিব্লই করবে, গোল দেওয়ার সাধ্য নেই।
যারা বুদ্ধিমান, তারা বাংলা ছেড়ে অন্য কোথাও পাড়ি দিচ্ছে। বিশেষত বিজ্ঞানের জগতে এ রকম নিরাশা কখনওই তারা উপলব্ধি করেনি। বিজ্ঞানের ডিগ্রি অন্যত্র যাওয়ার একটা ভিসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দাদাদের প্রচুর সচ্ছলতা। অনেক বিজ্ঞানীকে আমি ভাল করেই চিনি, তাঁরা আতঙ্কে অতীতে ফিরে যেতে চান, অতীতে বিজ্ঞানের গৌরবের কথা ভেবে বর্তমানের অন্ধকার ভুলে থাকতে চান।
কিন্তু অতীতের গৌরব এখন ম্লান, আর সামনের দিনে নতুনের সৃষ্টির কথা ভাবতেও বাঙালি সাহস পায় না। ভাবাতে চাইলে বলেন, দেখছেন না, মানুষ কী গরিব, কী দুঃস্থ, কী অপরিসীম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন! বাঙালি আশাহীন আলোহীন ভবিষ্যতের গভীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়েই আছে। এই পরিবেশে বিজ্ঞান করবেন? সে তো নিতান্তই শৌখিন বড়লোকি! দুঃখ আর কষ্টে পীড়িত বাঙালি কেবল নাটকই করবে, তাও রদ্দি। আর যারা নাটক করবে, তারাই হবে নেতা, শিক্ষাবিদ। বিজ্ঞান? আরে ধুর মশাই, ছাড়ুন তো!