Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

বিভাজন ও সংহতি

মেরুকরণের রাজনীতি আবার উত্তর ভারতের নির্বাচনী তত্‌পরতার মুখ্য উপাদান হইয়া উঠিতেছে। এক দিকে যদি জাতপাতের মেরুকরণ অর্থাত্‌ দলিত-অনগ্রসরদের ভোট সংহত করার প্রয়াস, অন্য দিকে তবে সম্প্রদায়ের ভোট সংহত করার উদ্যোগ। বিহারে লালুপ্রসাদ যাদব ও নীতীশ কুমার নিজেদের অহি-নকুল সম্পর্ক সরাইয়া রাখিয়া ভোটের স্বার্থে যে বিজেপি-বিরোধী জোট গঠন করে, তাহার সুফল দুই দলই হাতে-নাতে পাইয়াছে।

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

মেরুকরণের রাজনীতি আবার উত্তর ভারতের নির্বাচনী তত্‌পরতার মুখ্য উপাদান হইয়া উঠিতেছে। এক দিকে যদি জাতপাতের মেরুকরণ অর্থাত্‌ দলিত-অনগ্রসরদের ভোট সংহত করার প্রয়াস, অন্য দিকে তবে সম্প্রদায়ের ভোট সংহত করার উদ্যোগ। বিহারে লালুপ্রসাদ যাদব ও নীতীশ কুমার নিজেদের অহি-নকুল সম্পর্ক সরাইয়া রাখিয়া ভোটের স্বার্থে যে বিজেপি-বিরোধী জোট গঠন করে, তাহার সুফল দুই দলই হাতে-নাতে পাইয়াছে। সেখানে দশটি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে ছয়টি আসনই এই জোটের হস্তগত হইয়াছে এমন সময়, যাহার একশো দিন আগেই লোকসভা নির্বাচনে দুই দল কার্যত বিজেপির কাছে পর্যুদস্ত হইয়াছিল। অন্য দিকে উত্তরপ্রদেশের লোকসভা নির্বাচনে দলিত ও অনগ্রসরদের দুই দল, মায়াবতীর বহুজনসমাজ পার্টি এবং মুলায়ম সিংহের সমাজবাদী পার্টি ঐক্যবদ্ধ হইতে না পারায় এবং মুজফ্ফরনগর দাঙ্গার পর পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে হিন্দু ভোট সুসংহত করিতে পারায় বিজেপি অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। সেই রাজ্যেই পক্ষকালের মধ্যে এগারোটি বিধানসভা ও একটি লোকসভা আসনে উপনির্বাচন। মেরুকরণের রাজনীতি অনুশীলনের নূতন সুসময়।

বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ এই উপনির্বাচনে দলীয় প্রচার অভিযানের দায়িত্ব সঁপিয়াছেন গোরক্ষপুরের দলীয় সাংসদ যোগী আদিত্যনাথকে। গেরুয়াবসন এই রাজনীতিক পাঁচ বার লোকসভায় নির্বাচিত। ইতিমধ্যেই ষোড়শ লোকসভার ভিতরে ও বাহিরে জঙ্গি মুসলিম-বিরোধী মন্তব্য করিয়া তিনি বিতর্ক ছড়াইয়াছেন। তথাপি তাঁহাকেই নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করার মধ্যে হিন্দু ভোট এক মেরুতে টানার উদ্দেশ্য বিশেষ প্রচ্ছন্ন নহে। মুজফ্ফরনগরের পরে সহারনপুরেও একটি সীমাবদ্ধ দাঙ্গা সংঘটিত হইয়া গিয়াছে, যাহা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আরও কোণঠাসা করিয়াছে। এই অবস্থায় ‘প্রেম-জেহাদ’ তত্ত্ব হিন্দুত্বের শিবিরকে আরও সংহত করিতেই পারে। এক হিসাবে ইহা কমণ্ডলুর শিবিরকে শক্তিশালী করারই প্রয়াস, ঠিক যেমন নীতীশ কুমার ও লালুপ্রসাদ যাদবরা মণ্ডল রাজনীতির শিবিরকে ঐক্যবদ্ধ করিতে তত্‌পর। লালুপ্রসাদ তো বিহারের পরীক্ষা উত্তরপ্রদেশেও অনুকরণের জন্য মুলায়ম সিংহ যাদব ও মায়াবতীকে আর্জিও জানাইয়াছেন। মায়াবতী অবশ্য পত্রপাঠ তাহার সম্ভাবনা খারিজ করিয়াছেন।

কোথাও দলিত ও অনগ্রসরদের সহিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঐক্য সাধন করিয়া, আবার কোথাও উচ্চবর্ণীয়দের সহিত নিম্নবর্গীয়দের জোট গড়িয়া নির্বাচনী রাজনীতির ফসল তুলিবার প্রচেষ্টাই মেরুকরণের রাজনীতি, যাহা জনসাধারণের স্বাভাবিক সংহতি বিনষ্ট করে এবং তাঁহারা রাজনীতিকদের কাছে কেবল ভোটদাতা বর্গ রূপে গণ্য হন। গত শতাব্দীর আশির দশকে প্রথম যখন অনগ্রসরদের সংরক্ষণের দাবিতে মণ্ডল রাজনীতির অভিযান শুরু হয়, তখন হইতেই জাতপাতের আত্মপরিচয় এবং সেই পরিচয়ভিত্তিক ভোট-রাজনীতি ভারতীয় সমাজকে বিভাজিত করিতে থাকে। তখনই মণ্ডলের পাল্টা কমণ্ডলুর আওয়াজ তুলিয়া ‘হিন্দু সমাজ’কে একসূত্রে বাঁধিবার চেষ্টা শুরু হয়। এক দিকে সেই প্রয়াস সংখ্যালঘুদের দূরে ঠেলিয়া দেয়, তাঁহারা অনগ্রসর-দলিতদের সহিত জোট বাঁধেন। অন্য দিকে দলিতদের হিন্দুত্বে ফিরাইবার চেষ্টা হয়। এখনও সেই চেষ্টা চলিতেছে দলিত খ্রিস্টানদের পুনরায় ‘হিন্দু’ করার শুদ্ধকরণ যজ্ঞে। এই টানাপড়েন চলিতেই থাকিবে, কেননা রাজনীতিকদের ইহা প্রয়োজন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE