Advertisement
১৭ মে ২০২৪
প্রবন্ধ...

ভাবী প্রজন্মের জন্য যা আমরা করতেই পারি

আজ বাদে কাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। সেটা তুমুল হইচই করে পালিত হবে। নিশ্চয়ই তা হোক। কিন্তু আজ আবার বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে আমরা একটু সচেতন হলেও ভাল হয়। সচেতন হলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। আগে থেকে। জন্মের আগে থেকে। কারণ, সম্ভাব্য বাবা-মা’র রক্ত পরীক্ষা করলেই জানা যায়, তাঁদের সন্তানের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না। চিকিৎসা বিজ্ঞান আমাদের এই সুযোগ দিয়েছে।

চেতনা। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের একটি উদ্যোগ। পশ্চিমবঙ্গ, ২০১৩

চেতনা। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের একটি উদ্যোগ। পশ্চিমবঙ্গ, ২০১৩

প্রান্তর চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৪ ০০:০৭
Share: Save:

আজ বাদে কাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। সেটা তুমুল হইচই করে পালিত হবে। নিশ্চয়ই তা হোক। কিন্তু আজ আবার বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে আমরা একটু সচেতন হলেও ভাল হয়। সচেতন হলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। আগে থেকে। জন্মের আগে থেকে। কারণ, সম্ভাব্য বাবা-মা’র রক্ত পরীক্ষা করলেই জানা যায়, তাঁদের সন্তানের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না। চিকিৎসা বিজ্ঞান আমাদের এই সুযোগ দিয়েছে। অথচ আজও আমাদের দেশে প্রতি বছর কুড়ি-তিরিশ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মাচ্ছে। এবং আমার ধারণা আমাদের রাজ্যেই অন্তত তিন-চার হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মায়। কেন? কারণ তাদের বাবা-মায়ের রক্ত পরীক্ষা করানো হয়নি বা করানো হলেও, সন্তানের বিপদের আশঙ্কা সত্ত্বেও, সন্তানের জন্ম দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এক কথায়, সচেতনতার অভাব। সেই কারণেই আজকের দিনটার বিশেষ গুরুত্ব।

থ্যালাসেমিয়া একটি জিনঘটিত রোগ। দুনিয়ার মোটামুটি পাঁচ শতাংশ মানুষ এই ধরনের (সিক্ল সেল অ্যানিমিয়া এবং থ্যালাসেমিয়া) রোগের বাহক (কেরিয়ার), তাঁরা কেউই কিন্তু থ্যালাসেমিয়া রোগী নন। এই প্রসঙ্গে আমরা একটু পরেই ফিরে আসব। তার আগে রোগটা সম্পর্কে একটু বলা দরকার। এই রোগ থাকলে রক্তে হিমোগ্লোবিন ঠিক মতো তৈরি হয় না, এবং সেটা দেখে শরীর ভাবে, আরও আয়রন দরকার, ফলে শরীর ভুল করে দেহের বিভিন্ন অংশে আরও লোহা জমায়। তার ফলে শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, বিশেষ করে হার্ট এবং লিভারের সমস্যা। চিকিৎসা বলতে প্রধানত নিয়মিত বাইরে থেকে রক্ত দিয়ে যাওয়া এবং শরীরের বাড়তি লোহা বের করে দেওয়া। সে চিকিৎসা ব্যয়বহুল, কষ্টদায়ক। নিয়মিত রক্ত দিতে হয় বলে নানা ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকিও থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই একটা সময়ের পরে রোগীর প্রাণসংশয় হয়।

সমস্যাটা খুব বড় মাপের। বস্তুত, জিনঘটিত রোগগুলির মধ্যে থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে প্রতি বছর প্রায় কুড়ি থেকে তিরিশ হাজার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বাচ্চা জন্মাচ্ছে। যদি এখন থেকে এই রোগ প্রতিরোধে যথেষ্ট তৎপর হওয়া না যায় তা হলে আগামী কুড়ি বছরে প্রায় দশ লক্ষ থ্যালাসেমিয়া-আক্রান্ত মানুষ থাকবেন ভারতে। আর এর একটা বড় অংশই থাকবে পশ্চিমবঙ্গে। কেন? সেটাই আমাদের পক্ষে একটা বিশেষ চিন্তার কারণ।

অন্য নানা জেনেটিক ত্রুটির মতোই, থ্যালাসেমিয়াও পৃথিবীর সর্বত্র সমান হারে নেই। এর প্রথম সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে, অন্তত ন’হাজার বছর আগে। ‘থালাসা’ গ্রিক শব্দ, এর মানে হল সমুদ্র— পুরাণের সমুদ্রদেবী। এখন এই রোগের প্রাদুর্ভাব প্রধানত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এবং, ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও কয়েকটি রাজ্যে থ্যালাসেমিয়ার বাহক ও আক্রান্তের অনুুপাত সর্বাধিক। গোটা ভারতে শতকরা চার জন থ্যালাসেমিয়ার বাহক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সে হার দশ শতাংশ। দেখা যায়, উত্তরবঙ্গে বাহকের সংখ্যা আবার আরও বেশি।

এর অনেকগুলো সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। এক দল বিজ্ঞানী মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের দিকে ম্যালেরিয়ার খুব প্রকোপ ছিল। এতে প্রচুর মানুষ মারা যেতেন। এই ম্যালেরিয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জিন সম্ভবত কোনও একটা পরিবর্তন ঘটিয়ে নেয়, যাতে ম্যালেরিয়ার মৃত্যু কিছুটা কমে। কিন্তু তার ফলটা প্রকাশ হয় থ্যালাসেমিয়া রোগের জিনের মাধ্যমে। সেটা হাজার হাজার বছর আগে হয়েছিল, এবং বিবর্তনের নিয়ম অনুযায়ী এই জিনের প্রভাব পরিবর্তিত হতে হয়তো আরও কয়েক হাজার বছর লাগবে।

কিন্তু কী ভাবে আগে থেকে এই রোগের সম্ভাবনা জানা যাবে? আগেই বলেছি, অনেকেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হতে পারেন, কিন্তু থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত নন এবং— বাহক হলেও— তাঁর নিজের এই রোগ হওয়ার কোনও ভয় নেই। কারণ বাহক কিন্তু রোগী নন এবং জীবনে তিনি কোনও দিনই রোগী হবেন না। কিন্তু সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগে বাবা-মা থ্যালাসেমিয়া বাহক কি না, সেটা তাঁদের রক্ত পরীক্ষার সাহায্যে জেনে নেওয়া ভাল। কেন, সেটা বলি। বাবা বা মা, কেউ যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক না হন, তা হলে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া হবে না। বাবা বা মা, কেউ এক জন যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন কিন্তু অন্য জন না হন, তা হলে বাচ্চা থ্যালাসেমিয়ার বাহক হতে পারে কিন্তু তাতে তার কোনও ক্ষতি হবে না। যেমন ধরুন, ফুটবলার জিদান বা টেনিস প্লেয়ার পিট সাম্প্রাস, এঁরা থ্যালাসেমিয়া বাহক, কিন্তু এঁরা দিব্যি সুস্থ হয়ে জীবন যাপন করছেন।

সমস্যা হল, বাবা এবং মা দু’জনেই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন। তা হলে তাঁদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার ২৫ শতাংশ ঝুঁকি থাকে। এবং বলে রাখা দরকার, প্রত্যেক সন্তানেরই এই একই ঝুঁকি থাকে, অর্থাৎ এমন নয় যে, একটি সন্তানের থ্যালাসেমিয়া আছে বলে পরবর্তী সন্তানদের ঝুঁকি কমে যাবে— একটুও কমবে না।

এখন, আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থায় সন্তানধারণের ব্যাপারটা প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিয়ের সঙ্গে জড়িত। তাই সবচেয়ে ভাল হয় যদি বিয়ের আগে দু’জনেরই রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে সেটা চালু করতে হয়তো অনেক সময় লাগবে। আমরা তাই বলি যে, গর্ভাবস্থার কথা জানার সঙ্গে সঙ্গেই অন্তঃসত্ত্বার থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া দরকার। যদি দেখা যায়, তিনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক, তা হলে সন্তানের পিতার রক্ত পরীক্ষা করা দরকার। যদি তিনি বাহক না হন, তা হলে শিশুটির থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কোনও ভয় থাকবে না (যদিও সে বাহক হতে পারে)। কিন্তু যদি দেখা যায়, পিতাও থ্যালাসেমিয়ার বাহক, তা হলে গর্ভবতী মা’কে পরীক্ষা করে দেখা জরুরি যে, বাচ্চাটি থ্যালাসেমিয়া রোগী হতে চলেছে কি না। গর্ভধারণের বারো সপ্তাহেই এই পরীক্ষাটা করা যায়। যদি দেখা যায়, বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া আছে, তবে গর্ভপাত করিয়ে নেওয়া উচিত। এই গর্ভপাত আইনসম্মত, ভারতের স্বাস্থ্যবিধিতে স্বীকৃত, কারণ এ ভাবে পরবর্তী প্রজন্মকে ভয়ানক রোগের হাত থেকে বাঁচানো যায়। কয়েকটা রক্ত পরীক্ষাই সে জন্য যথেষ্ট। সেগুলো খুব খরচসাপেক্ষও নয়। দরকার কেবল পুরনো ভাবনাচিন্তা কাটিয়ে উঠে চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাহায্য নেওয়া।

পুরনো ভাবনাচিন্তার কথাটা বাস্তব কারণেই বললাম। আমাদের সমাজে এখনও মনে করা হয়, বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করানো মানে ছেলের বা মেয়ের দোষ রয়েছে। বিশেষ করে মেয়েদের তো প্রায় যে কোনও উপলক্ষে দোষের ভাগী করা হয়। অথচ এর কোনও মানেই নেই। প্রথমত, যদি কোনও সমস্যা থাকে, সেটা জেনে নেওয়া সব সময় ভাল, বিশেষ করে যেখানে পরে সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, যদি জিনঘটিত কোনও ত্রুটি থাকে, সেটাকে ‘দোষ’ বলার কোনও কারণই থাকতে পারে না। ছেলের বা মেয়ের— বিশেষ করে মেয়ের— বদনাম হবে, এই ভেবে সেটা লুকিয়ে রাখা অর্থহীন, অন্যায় এবং বিপজ্জনক। এতে পরে যাঁরা মা-বাবা হন, তাঁদের সন্তান যদি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হয়, তা হলে সেই সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জীবন আর্থিক ও মানসিক ভাবে ভয়ানক ভাবে বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। সোজা কথা হল, যদি দেখা যায় সম্ভাব্য বাবা এবং মা দু’জনেই থ্যালাসেমিয়া বাহক তা হলে সন্তানের জন্ম না দেওয়াই শ্রেয়। কারণ সন্তান এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

এ ব্যাপারে সামাজিক এবং সরকারি স্তরে একটা বড় উদ্যোগ করা জরুরি। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য কী কী করণীয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) সে বিষয়ে একটা গাইডলাইন তৈরি করতে বলেছে। এডস বা পোলিয়োর বিরুদ্ধে প্রচার এবং প্রতিষেধকের অভিযান দেখিয়ে দিয়েছে যে, সত্যিকারের উদ্যোগ করলে সাফল্য আসবে। কিন্তু থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে এখনও প্রায় কিছুই করা হয়নি। একটা বিনা পয়সায় টেলিফোন পরিষেবার হেল্পলাইনও তৈরি হয়নি। অথচ এই অসুখে কত মানুষের জীবনে অপরিসীম যন্ত্রণা, কত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এবং, আক্রান্তদের জন্য যে পরিমাণ রক্তের দরকার হচ্ছে, তাঁদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার পিছনে যে পরিমাণ অর্থ ও পরিকাঠামো ব্যয় করতে হচ্ছে— যে-ই করুক— সেটাও বিপুল।

এই রোগের চিকিৎসা আগের তুলনায় নিশ্চয়ই এগিয়েছে। গবেষণার জগৎ আপ্রাণ চেষ্টা করছে যাতে আরও ভাল ওষুধ বেরোয়। আমরা ভাবছি কত কম পয়সায় সেই ওষুধ বেরোলে ভারতের মতো গরিব দেশের রোগীরা চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ থাকতে পারেন। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ করার ওষুধ তো এখনও আবিষ্কার হয়নি। আর তাই এটাই বলতে হবে যে, এই রোগ যাতে না হয়, অর্থাৎ কোনও শিশু যেন থ্যালাসেমিয়ার আশঙ্কা নিয়ে না জন্মায়, সেটা নিশ্চিত করাই শ্রেয়। যা আমার হাতে আছে, অর্থাৎ নিজেকে পরীক্ষা করে নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচানো— এটুকু তো আমরা করতেই পারি। রবীন্দ্রনাথ তাতে আশীর্বাদই করবেন।

কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হেমাটোলজি বিভাগে শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

prantar chakrabarti thalassemia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE