Advertisement
০৪ জুন ২০২৪
সম্পাদকীয়১

ভুবনের ভার

যে কোনও বৃহৎ সংকটে, ত্রাণের জন্য সমাজ রাষ্ট্রের দিকে তাকাইয়া থাকে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনস্বীকার্য, কিন্তু ব্যক্তি-নাগরিকও যে বিপত্তারণ-প্রক্রিয়ায় হাত লাগাইতে পারে, উহা ভাবি না। কারণ তাহা হইলে, নিজেকেও দায় লইতে হয়। বার্লিনে সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী, বিশ্বের আবহাওয়া সম্পর্কিত রিপোর্টে বলিল, গত এক দশকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং বিশ্ব উষ্ণায়নে রাশ টানিতে গেলে এখনই বদলাইতে হইবে প্রচলিত প্রযুক্তি ব্যবহার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি। একই সঙ্গে, সাধারণ মানুষকেও তাঁহাদের জীবনযাত্রার ধরনে কিছু স্বেচ্ছা-পরিবর্তন ঘটাইতে হইবে।

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

যে কোনও বৃহৎ সংকটে, ত্রাণের জন্য সমাজ রাষ্ট্রের দিকে তাকাইয়া থাকে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনস্বীকার্য, কিন্তু ব্যক্তি-নাগরিকও যে বিপত্তারণ-প্রক্রিয়ায় হাত লাগাইতে পারে, উহা ভাবি না। কারণ তাহা হইলে, নিজেকেও দায় লইতে হয়। বার্লিনে সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী, বিশ্বের আবহাওয়া সম্পর্কিত রিপোর্টে বলিল, গত এক দশকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং বিশ্ব উষ্ণায়নে রাশ টানিতে গেলে এখনই বদলাইতে হইবে প্রচলিত প্রযুক্তি ব্যবহার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি। একই সঙ্গে, সাধারণ মানুষকেও তাঁহাদের জীবনযাত্রার ধরনে কিছু স্বেচ্ছা-পরিবর্তন ঘটাইতে হইবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের বৈশিষ্ট্য হইল, সর্বদা স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়া, সরকারের প্রচারে কান না দিয়া, সাড়ম্বর অ-সচেতনতা উদযাপন। নিয়ম মানিতে বলিলে, সমষ্টির জন্য চিন্তা করিতে বলিলে, সে খেপিয়া উঠে। সে মেট্রো রেলের ব্যাগ-তল্লাশিকারির উপরেও বিরক্ত, ফুটব্রিজ ব্যবহার করিতে বলা স্বেচ্ছাসেবীর উপরেও বিরক্ত, মুদির দোকানে প্লাস্টিক না দিতে চাহিলে সে রইরই করিয়া তাড়না করে।

কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়ন ঠেকাইতে হইলে, কেবল আইনি কোপের ভয়ে কাপড়ের থলি ব্যবহার করিলেই হইবে না। প্রত্যক্ষ চেষ্টা করিতে হইবে। গাড়ির ব্যবহার কমাইলে বিশ্ব উষ্ণায়ন কমিবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের নিকট গাড়ি মহার্ঘ। গাড়ি থাকা সত্ত্বেও বাসে-মেট্রোয় অফিস যাইলে সে টিটকিরির পাত্র হইবে। গাড়ি করিয়া যাইলেও, অন্য কয়েক জনের সহিত একটি গাড়িতে যাইবার বন্দোবস্ত যদি করা যায়, তাহা হইলে পাঁচটির স্থানে একটি গাড়ি বাহির হইবে, দূষণ অনেক কমিয়া যাইবে। কিন্তু শকট-অধিকারীর অহং আহত হইবে। সেই অহং লালন যে এই গ্রহের কল্যাণ অপেক্ষা অধিক জরুরি নয়, ইহা বুঝিতে হইবে। বৃক্ষরোপণে উৎসাহী হইতে হইবে। নিজ বাতায়নে আলো কম আসিতেছে বলিয়া বৃহৎ বৃক্ষের মাথা মুড়াইয়া দিলে চলিবে না। চেষ্টা করিতে হইবে এমন পণ্য ব্যবহার করিবার, যাহা এক বার ব্যবহৃত হইবার পর নষ্ট না করিয়া অন্য ভাবে ব্যবহারোপযোগী করিয়া গড়া হইয়াছে। আমিষ অপেক্ষা নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসকে গুরুত্ব দিতে হইবে (পশুপালন কমিলে মিথেন গ্যাসের নির্গমন কমিবে)। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, বা অন্যান্য শক্তির উপর নির্ভরতা বাড়াইতে হইবে। কম দূরত্বে যাইতে হইলে হাঁটিতে হইবে বা সাইকেল ব্যবহার করিতে হইবে। কিন্তু এই সকল কাজ করিতে হইলে, মানসিকতাটিই বদলাইতে হইবে। নিজ তাৎক্ষণিক আরাম অপেক্ষা বিশ্বের দীর্ঘকালীন মঙ্গলের কথা ভাবিতে হইবে। সেই অনুশীলন কঠিন। কিন্তু এই সংকটে সম্ভবত তাহা একমাত্র পথ।

তবে অনেকে বলিতেছেন, এই কঠিন অভ্যাস আয়ত্ত করিবার ভার সকলের উপর চাপাইয়া দিয়া কৌশলে যে কথাটি এড়াইয়া যাওয়া হইতেছে, তাহা হইল: বিশ্ব উষ্ণায়নে প্রথম বিশ্বের দেশগুলির দায়। এখন যেন বলা হইতেছে, অতীত লইয়া ভাবিয়া আর লাভ নাই, ভবিষ্যতে সকলেই সমান দায়িত্ব ভাগ করিয়া লউক। কিন্তু প্রথম বিশ্বের শিল্প ও গাড়ি-আধিক্যের জন্য বিশ্ব আজ এই বিপদে উপনীত, এইটি মনে না রাখিলে সমস্যার শিকড়টিই অস্বীকার করা হইবে। তাহাতে সমাধান-প্রক্রিয়াও একঝোঁকা হইয়া যাইবার সম্ভাবনা। এই সচেতনতা ও কার্যসূচির দায় এবং আত্মসংযম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিশ্বকে নিরাপদ রাখিবার দায়িত্বের সিংহভাগ প্রথম বিশ্বের সাধারণ মানুষ বহন করিলে, তাহাই সুসমঞ্জস ও ন্যায়সঙ্গত হয়। তৃতীয় বিশ্বের মানুষের উপরেও ভুবনের ভার চাপাইয়া দিবার পূর্বে, সম্যক বিচার করিয়া, অধিক ভার প্রথম বিশ্বের সমৃদ্ধ স্কন্ধগুলিতে অর্পণ করিলে, রিপোর্ট নাতিশীতোষ্ণ হইত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE