Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

ভারতীয় সমাজ এবং জনপ্রিয় বামপন্থা

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জনসঙ্ঘের জন্ম দিলেও বাঙালির রাজনীতির ডিএনএ-তে কিন্তু বাম র‌্যাডিক্যালিজম-এর শেকড় অনেক শক্ত। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যখন ছাত্র ছিলেন, তখন তিনি নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। ছাত্র জীবনের সেই ডায়েরি বই হিসেবে প্রকাশিত হয়, যার নাম ‘দিনলিপি’। স্যর আশুতোষ উপাচার্য হিসাবে কেমন ছিলেন, শিক্ষাবিদ হিসেবে কেমন ছিলেন— এ সব কথা আমরা অনেকটা জানি। কিন্তু, ছাত্রজীবনে যখন বিএ পরীক্ষার জন্য বাড়িতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সেই সময় অল্প বয়সের আশুতোষের মানসিকতা কেমন ছিল, সেটা এই বই থেকে অনেকটা জানা যায়।

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যখন ছাত্র ছিলেন, তখন তিনি নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। ছাত্র জীবনের সেই ডায়েরি বই হিসেবে প্রকাশিত হয়, যার নাম ‘দিনলিপি’।

স্যর আশুতোষ উপাচার্য হিসাবে কেমন ছিলেন, শিক্ষাবিদ হিসেবে কেমন ছিলেন— এ সব কথা আমরা অনেকটা জানি। কিন্তু, ছাত্রজীবনে যখন বিএ পরীক্ষার জন্য বাড়িতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সেই সময় অল্প বয়সের আশুতোষের মানসিকতা কেমন ছিল, সেটা এই বই থেকে অনেকটা জানা যায়।

সেই ‘দিনলিপি’ পড়তে পড়তে দেখলাম, আশুতোষ কিন্তু ছাত্রজীবনে বেশ মারমুখী আন্দোলনকারী ছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাগজ ‘বেঙ্গলি’তে কোনও একটি প্রকাশিত প্রবন্ধের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনে। সুরেনবাবুকে সে জন্য আদালতে যেতে হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিপুল উত্তেজনা তৈরি হয়। আশুতোষের নেতৃত্বে ছাত্রেরা এই ঘটনার প্রতিবাদে বাসের কাচ ভাঙে, কলেজের চেয়ার-টেবলও ভাঙচুর হয়। এই ‘দিনলিপি’ থেকে আরও জানতে পারলাম, ছাত্র আন্দোলনের জন্য কলকাতার ট্রামে ছাত্রদের মাসিক কনসেশন তুলে দেওয়া হয়। তখন তার বিরুদ্ধেও কিন্তু আন্দোলন শুরু হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি যত বোঝার চেষ্টা করি, ততই মনে হয় যে, অতীতেও বাঙালির রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে প্রতিবাদের স্বরূপ বরাবরই জোরালো ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়েও বিনয়-বাদল-দীনেশ থেকে সূর্য সেন— চরমপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনে কিন্তু বাঙালির অবদান কম ছিল না। আশুতোষ অবশ্য নিজেই লিখেছেন, বেশি রাজনীতির জন্য পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছিল। তাই তিনি পরীক্ষার আগে রাজনীতি থেকে সরে আসেন। খুব ভোরবেলায় উঠতেন ঘুম থেকে, ৩-৪টের সময়। আর উঠে সংস্কৃত, সাহিত্য এবং দর্শন পড়তেন। সেখানে কালিদাস থেকে উপনিষদ, সবই ছিল। আশুতোষের বাবা ছিলেন চিকিৎসক। কিন্তু, পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জঙ্গি রাজনীতির পথে না গিয়ে গোটা দেশ জুড়ে একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

মজার ব্যাপার, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জনসঙ্ঘের জন্ম দিলেও বাঙালির রাজনীতির ডিএনএ-তে কিন্তু বাম র্যাডিক্যালিজম অনেক বেশি শক্তপোক্ত ভাবে শিকড় গেড়েছে। সম্প্রতি ‘ক্যারাভান’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিবন্ধে রামচন্দ্র গুহ প্রশ্ন তুলেছেন, বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এলেও কোথায় গেল দক্ষিণী রক্ষণশীল বিদ্বৎসমাজ? অতীতে, স্যর আশুতোষের সময়ে বাঙালির মেধাজীবীরা কিন্তু হিন্দু ধর্ম, হিন্দু শাস্ত্র নিয়ে গভীর ভাবে পড়াশোনা করতেন। ফলে সে দিনের মেধাজীবীদের দর্শনে কিন্তু ভারতীয় ঐতিহ্য খুব জোরালো ছিল। হরনাথ শাস্ত্রী থেকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ থেকে রবীন্দ্রনাথের গোরা সর্বত্রই এই হিন্দু শাস্ত্র ও দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা ছিল খুব বেশি। সুমিত সরকারের মতো ঐতিহাসিক অবশ্য পরবর্তী কালে বলেছেন, ভারতের মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদ অনেকাংশেই প্রতিক্রিয়া। স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যম যদি হিন্দু মহাসভা হয়, তা হলে এই সংস্থার নামকরণই তো একটি বড় সংখ্যালঘু সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব থেকে ১৯৪৯-এর চিনের বিপ্লব, এই দীর্ঘ সময় কিন্তু বাঙালি মননে বাম ও সমাজতান্ত্রিক দর্শন প্রভাব ফেলে। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যার কাণ্ডারী ছিলেন নেহরু স্বয়ং। নেহরু ও বাম নেতাদের মধ্যে ফারাক যা-ই থাক, ক্রমশ দেখা যায় যে ভারতীয় সমাজে বাম ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবীদের দাপট অনেক বেড়ে যাচ্ছে। তুলনামূলক ভাবে দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবীরা আজ কোথায়? রামচন্দ্র গুহর সমালোচনা হল, এই কারণেই ইতিহাস পরিষদে কিংবা বিভিন্ন শিক্ষা সংস্থায় বিজেপি সরকারকে অযোগ্য তাঁবেদারদের বসাতে হচ্ছে।

বাঙালি শুধু নয়, গোটা দেশেই তাই অতীতের ভারতীয় দর্শনচর্চার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে এসে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা সমাজতন্ত্র এবং মাকর্সবাদের চর্চাকে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক করে তোলেন। কিন্তু পুঁজিবাদের বিকাশ গোটা দুনিয়া জুড়ে যতই হোক না কেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে বিজেপি রিপাবলিকান পার্টির মতো একটা সত্যিকারের দক্ষিণপন্থী সংস্কারমুখী দল হয়ে উঠতে পারেনি। হয়ে উঠতে পারেনি কনজারভেটিভ পার্টির উত্তরসূরিও হতে। মনমোহন সিংহের সরকারের মতো মোদী সরকারও যত না দক্ষিণপন্থী, তার চেয়েও বেশি বামপন্থী বলে অনেকে মনে করছেন।

আজকের শাহি সমাচার-এর পাঠকের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, ভারতীয় সমাজের মধ্যেই কি নিহিত আছে এক ধরনের জনপ্রিয় বামপন্থা?


—ফাইল চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE