Advertisement
২৩ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

ভুলের পর ভুল

একটি ভুলের সংশোধন কি পরবর্তী ভুলের মাধ্যমে হইতে পারে? টাটা স্টিল ব্রিটেনের ব্যবসা গুটাইয়া লওয়ার সিদ্ধান্ত করায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ৪০,০০০ মানুষের চাকুরি খোওয়াইবার উপক্রম হইয়াছে। স্বভাবতই রাজনীতিকরা মাঠে নামিয়া পড়িয়াছেন।

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৬ ০০:১১
Share: Save:

একটি ভুলের সংশোধন কি পরবর্তী ভুলের মাধ্যমে হইতে পারে? টাটা স্টিল ব্রিটেনের ব্যবসা গুটাইয়া লওয়ার সিদ্ধান্ত করায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ৪০,০০০ মানুষের চাকুরি খোওয়াইবার উপক্রম হইয়াছে। স্বভাবতই রাজনীতিকরা মাঠে নামিয়া পড়িয়াছেন। ইস্পাত উৎপাদনে সরকারি ভর্তুকির দাবি করিতেছেন, কেহ আবার ক্ষেত্রটিকে ফের রাষ্ট্রায়ত্ত করিবার কথাও বলিতেছেন। বাজারে যে ব্যবসার ভবিষ্যৎ নাই, রাষ্ট্রকে তাহার সম্মুখে জুতিয়া দেওয়ার প্রবণতাটি, দৃশ্যত, বিশ্বজনীন। এবং, মারাত্মক ভুল। ব্রিটেনে এখনও ইস্পাত উৎপাদনের চেষ্টা চালাইয়া যাওয়া প্রথম ভুল, এবং সেই ভুলের ধাক্কা সামলাইতে রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হওয়া দ্বিতীয় ভুল। ব্রিটেনের রাজনীতিকরা ভাবিতে পারিতেন, সে দেশে ইস্পাত উৎপাদনের যৌক্তিকতা আছে কি? তাঁহাদের আকরিক লৌহ নাই, কয়লাও কার্যত নাই। থাকিবার মধ্যে আছে শুধু ঐতিহাসিক গরিমা— যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হইত না, তখন ইস্পাত উৎপাদনেও ব্রিটেনের আধিপত্য ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় সেই কথাটি আর সত্য থাকে নাই। বিশ্বায়িত দুনিয়ায় আরও নহে। ব্রিটেনের ইস্পাত ক্ষেত্রের বর্তমান বিপর্যয় আসলে প্রতীকী— বাস্তব ভুলিয়া অতীত গরিমা আঁকড়াইয়া থাকিলে এমনই হয়।

সমস্যা শুধু ব্রিটেনের নহে। সমস্যা কেবল ইস্পাত ক্ষেত্রেরও নহে। সমস্যাটি বিশ্বব্যাপী। বিশ্বায়ন নামক আর্থিক প্রক্রিয়াটি গোটা দুনিয়াকে বদলাইয়া দিয়াছে। সমাজতন্ত্রের ভূত নামিয়াছে। রুটির জন্য নিজেকেই গম উৎপাদন করিতে হইবে, তেমন বাধ্যবাধকতা আর নাই। ফলে, দুনিয়ার যে প্রান্তে যাহা সস্তায় উৎপন্ন হয়, সেখান হইতে তাহা আমদানি করিয়া লওয়াই এখন বিশ্ব-অর্থনীতির মূল সুর। দুনিয়ার অধিকাংশ দেশই এখন খোলা বাজারের অংশ। সমস্যা হইল, রাষ্ট্র এখনও বাজারের উপস্থিতিকে সম্পূর্ণ মানিয়া লইতে পারে না। ফলে, যাহা নিতান্তই অকর্তব্য, জোর করিয়া তাহাই করিতে চাহে। ব্রিটেন যেমন এখনও ইস্পাত উৎপাদনের মোহ কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই। তাহার ফল হয় বিষম। বাজারের ধাক্কায় ক্ষেত্রটি ক্রমেই আরও অ-লাভজনক হইয়া উঠিতে থাকে। তখনই আসে ভর্তুকির দাবি, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের দাবি। ব্রিটেনের রাজনীতিকদের একাংশ দাবি করিতেছেন, প্রয়োজনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করিয়া ব্রিটেন ইস্পাত ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিক। ইউনিয়নের প্রশ্নটি বৃহত্তর, কিন্তু শুধু ইস্পাত ক্ষেত্রের প্রেক্ষিতে দেখিলে বোঝা যায়, দাবিটি অকুশলতার নূতনতর দিগন্ত খুলিবার প্রচেষ্টা। বাজারের শক্তির বিরোধিতা বুদ্ধিমানের কাজ নহে। মুশকিল হইল, রাজনীতি এই সহজ কথাটি বুঝিতে চাহে না।

কেহ বলিতে পারেন, এই অবস্থার জন্য বাজারের শক্তি দায়ী নহে, দোষ চিনের। দুনিয়ার মোট ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেক চিনেই হয়। আপাতত সে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা তলানিতে, ফলে চিন উৎপাদন ব্যয়ের ঢের কম দামে গোটা দুনিয়ায় ইস্পাত বেচিতেছে। প্রতিযোগিতার বাজারে ইহা গ্রহণযোগ্য নহে। কিন্তু, উৎপাদন ব্যয়ের কম দামে পণ্য রফতানি করিবার অর্থ, চিনের নাগরিকরা অন্য দেশের নাগরিকদের প্রকৃত ইস্পাত-ব্যয়ের একটি অংশ স্বেচ্ছায়, অথবা রাষ্ট্রের ইচ্ছায়, বহন করিতেছেন। শিকাগো স্কুলের অর্থনীতিবিদরা বলিবেন, তাহাতে আপত্তি করিবার বদলে উচ্ছ্বসিত হওয়া বিধেয়! বিশেষত, ব্রিটেনের ন্যায় দেশের, যেখানে স্বভাবতই ইস্পাত শিল্পের কোনও ভবিষ্যৎ নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE