নভেম্বর শুধু বিপ্লবের মাস নহে। উত্সবেরও। কলিকাতার ‘আন্তর্জাতিক’ চলচ্চিত্র উত্সব। বামফ্রন্ট শাসনের আরও একটি উত্তরাধিকার। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চলচ্চিত্র পছন্দ করিতেন। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র। অতএব, তাঁহার সবিশেষ আগ্রহে কলিকাতার চলচ্চিত্র উত্সবে মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিয়নি, মিগেল লিতিন, ক্রিস্তফ জানুসিরা আসিতেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কুর্শিচ্যুত করিয়াই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার সাধের চলচ্চিত্র উত্সবকে ফেলিয়া দেন নাই। বিনোদনে তাঁহার রুচি সর্বজনবিদিত। যাত্রা উত্সবের পার্শ্বে চলচ্চিত্রকেও ঠাঁই দিতে তাঁহার সমস্যা হয় নাই। বরং, উত্সবটিকে তিনি নূতনতর মাত্রায় লইয়া গিয়াছেন। এখন বলিউড, টলিউডের তারকারা উত্সবের মুখ। এই বত্সর ফের নূতন মাত্রা জুড়িল। উত্সবের শ্রেষ্ঠ ফিল্মটি ৫১ লক্ষ টাকা পুরস্কার পাইবে। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, শ্রেষ্ঠ নির্দেশকদের জন্যও পুরস্কার আছে। টাকার অঙ্ক মুখ্যমন্ত্রীর সহিত আলোচনার পর স্থির হইবে বলিয়া জানা গিয়াছে। পুরস্কারের টাকা রাজকোষ হইতেই আসিবে এই বার আর সারদার ন্যায় সংস্থাকে ধারেকাছেও ঘেঁষিতে দেওয়া হইবে না। খরচের বহর বাড়িয়াছে। গত বত্সরের সাত কোটি হইতে এই দফায় খরচ বাড়িয়া হইতেছে ২০ কোটি। ২৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি।
জনগণের করের টাকায় ফিল্মোত্সব হইবে কেন, তাহার একটি উত্তর পাওয়া যাইতেছে। এই উত্সব নাকি বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নার্থে। শূন্যপ্রায় রাজকোষের টাকায় হঠাত্ চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন করিতে হইবে কেন, এই প্রশ্নটি আপাতত উহ্য থাকুক। মুখ্যমন্ত্রী চলচ্চিত্রমোদী, অতএব সরকার এই শিল্পের কথা ভাবিবে অতি দুর্বল হইলেও ইহা একটি যুক্তি বটে। কিন্তু, টালিগঞ্জের উন্নতি যদি করিতেই হয়, সরাসরি করিলেই হইত। তাহার উপায়ও সহজবোধ্য। সরকার চলচ্চিত্র শিল্পের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করিতে পারিত। ‘রূপায়ণ’ নামে একটি কালার ল্যাব এই রাজ্যে তৈরি হইয়াছিল। তাহার কী অবস্থা? ছোট-বড় সকল ছবিই ‘পোস্ট-প্রডাকশন’ কাজের জন্য চেন্নাই যায়। কলিকাতায় পরিকাঠামো নাই। সরকার সেই পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করিতে পারিত। কিন্তু, এই প্রস্তাবে সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রীর মন উঠিবে না। তিনি শাহরুখ খানাদি তারকাদের সান্নিধ্য পছন্দ করেন। কিন্তু, সেই সান্নিধ্যলাভের জন্য কুড়ি কোটি টাকা ব্যয়— খরচ কিঞ্চিত্ বেশি পড়িল না?
সরকার পক্ষ বলিতে পারে, উত্সব উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র শিল্প সর্বভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে জায়গা পাইবে। তাহাতে টালিগঞ্জের গুণগত উন্নতি হইবে। ইহা পরোক্ষ লাভ। আগামী কয়েক দিন সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা উত্সব প্রাঙ্গণে থাকিবে, সত্য। কিন্তু, সেই ক্যামেরায় কোন তারকাদের ছবি ধরা পড়িবে, সেই বিষয়েও সংশয় নাই। বলিউডের বর্তমান এবং অতীত তারকাগণ উপস্থিত থাকিলে প্রচারের সিংহভাগ জুড়িয়া তাঁহারাই থাকেন। লাভ যতটুকু হওয়ার, তাঁহাদের হইবে। কলিকাতা পুস্তকমেলার সহিত তুলনা অস্বাভাবিক নহে। সেখানেও সরকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নানাবিধ সাহায্য করেন এবং মেলা হইতে উপার্জিত রাজস্বের সিংহভাগ চলিয়া যায় পশ্চিমবঙ্গের বাহিরে। সরকারি ভর্তুকি দিয়া অন্য রাজ্যের ব্যবসা বাড়াইবার এই নীতিই পশ্চিমবঙ্গে স্বাভাবিক বলিয়া গণ্য হইয়াছে। রাজকোষের টাকা খরচ করিয়া বলিউডের তারকাদের খানিক প্রচারের ব্যবস্থা করিয়া দেওয়ার মধ্যে অভিনবত্ব আছে, বিচক্ষণতা নাই। ইহাকে টালিগঞ্জের লাভের খাতায় লিখিতে চাহিলে হিসাবশাস্ত্রের নূতন পাঠের প্রয়োজন। কিন্তু, এত অজুহাতের প্রয়োজন ছিল না। সারদা হইতে খাগড়াগড়, যাদবপুর হইতে হলদিয়া, মুখ্যমন্ত্রী সমস্যায় জেরবার। তাঁহার মনোভার লাঘব করিবার জন্য বিনোদন প্রয়োজন হইলে তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে বইকী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy