Advertisement
০২ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ২...

মাতৃঘাতী বাঙালি

পরশুরাম পিতৃ-আজ্ঞায় মাতৃহত্যা করিয়াছিলেন। অতঃপর অনুতপ্ত হইয়া পিতার কাছে মাতার পুনরুজ্জীবন চাহিয়া লইয়াছিলেন। এ যুগের বাঙালি স্বেচ্ছায় মাতৃবধে লিপ্ত থাকিয়াও নির্বিকার, অনুতাপহীন। সংস্কৃত সাহিত্য পরিষৎ অর্থাভাবে বিপন্ন, তবু রাজ্য বা কেন্দ্র কাহারও হেলদোল নাই। সংস্কৃত যে প্রকৃত জন্মদাত্রী, বাংলা ভাষা তাহারই স্তন্যে লালিত, মাতৃহন্তারকরা খেয়াল করিল না। শুধু বাংলা নহে। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতীক: সত্যমেব জয়তে।

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৪ ০৪:১১
Share: Save:

পরশুরাম পিতৃ-আজ্ঞায় মাতৃহত্যা করিয়াছিলেন। অতঃপর অনুতপ্ত হইয়া পিতার কাছে মাতার পুনরুজ্জীবন চাহিয়া লইয়াছিলেন। এ যুগের বাঙালি স্বেচ্ছায় মাতৃবধে লিপ্ত থাকিয়াও নির্বিকার, অনুতাপহীন। সংস্কৃত সাহিত্য পরিষৎ অর্থাভাবে বিপন্ন, তবু রাজ্য বা কেন্দ্র কাহারও হেলদোল নাই। সংস্কৃত যে প্রকৃত জন্মদাত্রী, বাংলা ভাষা তাহারই স্তন্যে লালিত, মাতৃহন্তারকরা খেয়াল করিল না। শুধু বাংলা নহে। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রতীক: সত্যমেব জয়তে। নেপালে জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ইন্দোনেশিয়ায় গরুড় পঞ্চশীল। যে ভারতীয় ভাষার গর্ভে দক্ষিণ এশিয়ায় তিনটি রাষ্ট্রীয় প্রতীকের জন্ম, তাহার দুর্দশায় সন্তান আজ চিন্তিত নহে।

এই পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিশা দেখাইতে পারেন। প্রথমত, বহুভাষী ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে সংস্কৃত কোনও দিনই ধ্রুপদী ভাষা হিসাবে স্বীকৃত হয় নাই। সংবিধানের অষ্টম তফসিলে মুড়ি, চানাচুর একত্রিত হইবার মতো সিন্ধি, সংস্কৃত ও সাঁওতালি সকলেই আঞ্চলিক ভাষা। মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার রাজ্যে সংস্কৃতকে ধ্রুপদী মর্যাদায় উন্নীত করিতে পারেন। প্রসঙ্গত, অমর্ত্য সেন সম্প্রতি ভারতে ধ্রুপদী শিক্ষার অবহেলা লইয়া আক্ষেপ করিয়াছেন। মহাত্মা গাঁধী বহুকাল পূর্বে শিশুদের মাতৃভাষার পাশাপাশি একটি ধ্রুপদী ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা জানাইয়াছিলেন। রাজনীতিতে গাঁধীর উত্তরসূরিরা কেহ সেই কথায় কর্ণপাত করেন নাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়ে অগ্রসর হইলে প্রকৃত নেতার কাজ করিবেন। তাঁহার ঐতিহাসিক দায়ও আছে। বাম সরকার ইংরাজির পাশাপাশি মৃত ভাষা বলিয়া স্কুলের পাঠক্রম হইতে সংস্কৃত তুলিয়া দেয়। অতঃপর পাড়ায় পাড়ায় যে ‘দূর্গা’ হাজির হন, বিজ্ঞাপন হইতে টিভি সিরিয়াল, সংবাদপত্র সর্বত্র বাংলা ভাষায় ‘ফুল মস্তি’ চলে, তাহার পিছনে সংস্কৃত উৎপাটনের ভ্রান্তিও কাজ করিতেছে। মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ জাতীয় হরেক স্লোগান দিয়াও বামেরা বুঝিতে পারেন নাই, সংস্কৃতই প্রকৃত মাতৃভাষা। উহা না থাকিলে বাংলা ভাষার গতি অনাথ আশ্রমে। বঙ্কিমচন্দ্র বহুকাল পূর্বে লিখিয়াছিলেন, ‘বাঙ্গালার অস্থি, মজ্জা, শোণিত, মাংস সংস্কৃতেই গঠিত।’ বঙ্কিম বিস্মৃত, সংস্কৃতিঋ

দ্ধ মন্ত্রীরা কেহ কেহ লাতিন আমেরিকান লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের শতবর্ষের নির্জনতায় বিভোর ছিলেন। কিন্তু সেই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র মেলকিয়াদেস যে তাহার বইটি সংস্কৃত ভাষায় রচনা করে, তাহা খেয়াল করেন নাই। শাস্ত্রসম্মত বামাচারীরা মাতৃ-আরাধনা করেন, রাজনৈতিক বামাচারীরা মাতৃহত্যা করেন।

মুখ্যমন্ত্রী বাংলার কৃষ্টিকে নানা ভাবে উড্ডীন করিতেছেন। মনে রাখিতে হইবে, শ্রীচৈতন্যের জন্মস্থান ব্যতিরেকেও নবদ্বীপ খ্যাত ছিল রঘুনাথ শিরোমণির ন্যায়দর্শন চর্চার জন্য। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢের পূর্বে বাঙালি শিক্ষায় উৎকর্ষকেন্দ্র গড়িয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু এত উজ্জ্বল ইতিহাস সত্ত্বেও সংস্কারের কাজটি আজ সহজ নহে। প্রথমত, মানসিকতার বদল ঘটাইতে হইবে। সংস্কৃত কেবল চালকলা বাঁধার অংবংচং কিংবা বেদ, উপনিষদের দর্শনচর্চা নহে। পাণিনির সংস্কার-করা ভাষাকাঠামোয় চমৎকার গণতান্ত্রিকতা বিদ্যমান। একই কথা বহু রূপে বলা যায়। ভাষার এই নমনীয়তা পড়ুয়াদের চিৎকার নহে, তর্কশীল বিচারে উদ্বুদ্ধ করে। অতএব সংস্কৃতকে স্বমহিমায় ফিরাইতে হইবে। অন্যথা প্রমাণিত হইবে, বাঙালি মাতৃঘাতীও বটে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE