মুখ্যমন্ত্রী প্রথমাবধি সারদা-দুর্নীতির সিবিআই তদন্ত চাহেন নাই, এতৎসত্ত্বেও সিবিআই তদন্ত আরম্ভ হইতেছে, কারণ সর্বোচ্চ আদালত তাহা চাহিয়াছে। এই সরল সত্যটির মধ্যেই নিহিত রহিয়াছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা সরকারের বৃহৎ প্রশাসনিক পরাভব। রাজ্য সরকারের তরফে যেটুকু তদন্ত এ যাবৎ হইয়াছে, তাহা সন্তোষজনক নয় বলিয়া আদালত কেন্দ্রীয় সংস্থার হস্তক্ষেপ আহ্বান করিয়াছে। সুতরাং এই সিদ্ধান্তের অভিমুখ যে রাজ্য সরকারের বিপক্ষেই, তাহা তর্কাতীত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতই নানা কথায় ভাবে ভঙ্গিতে হুমকিতে বলিবার চেষ্টা করুন না কেন যে, সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে তাঁহার ও তাঁহার সরকারের ‘কিছুই আসে যায় না’, সাধারণ রাজনীতি-বোধই বলিয়া দেয়, তাঁহার ও তাঁহার সরকারের নিশ্চয়ই বেশ অনেকখানি ‘আসিয়া-যাওয়া’ উচিত। প্রথমত, সারদা-তদন্ত না আগাইবার দায়িত্ব সম্পূর্ণত সরকারের কাঁধেই বর্তায়। দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রীর বুঝা উচিত যে, দলীয় ক্ষুদ্রদৃষ্টি ও ক্ষুদ্রস্বার্থের বৃত্তে আটকা পড়িয়া কী ভাবে তিনি কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতেও রাজ্যের পরাজয় ঘটাইয়া দিয়াছেন। রাজ্য প্রশাসন এত অদক্ষ ও অযোগ্য ভাবে তদন্ত পরিচালনা না করিলে সম্ভবত এ ভাবে তাহাকে ডিঙাইয়া সিবিআই আবারও রাজ্যে প্রবেশ করিতে পারিত না। শোনা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় না কি যুক্তরাষ্ট্রীয়তার নিবেদিত সৈনিক, রাজ্য-অধিকারের বিশিষ্ট উদ্গাতা। কিন্তু এমন ছিদ্র-জর্জরিত প্রশাসন-পরিচালনা লইয়া কি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজ্য-অধিকারের বড়াই করা যায়?
এস আই টি বা বিশেষ তদন্ত দল গোটা এক বৎসর ধরিয়া কাজ করিবার পরও লগ্নিকৃত অর্থের সন্ধান মিলে নাই, দৃশ্যত তাহার সন্ধানের যথেষ্ট প্রয়াসও হয় নাই। সরকারি হলফনামায় এই বিপুল পরিমাণ অর্থের যেটুকু বিবরণ মিলিয়াছে, তাহা হয় দায়সারা, কিংবা বিস্ময়কর ভাবে সংক্ষিপ্ত। সুপ্রিম কোর্ট সঙ্গত ভাবেই মন্তব্য করিয়াছে যে, যেখানে আড়াই হাজার কোটি টাকার নয়ছয়, এবং এতগুলি রাজ্য জুড়িয়া সেই নয়ছয়ের বিস্তার, সেখানে কী করিয়া সরকারি তদন্ত এতখানি ঔদাসীন্য দেখাইতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ এখনও পর্যন্ত মাত্র চল্লিশ কোটির সম্পদ উদ্ধার করিতে পারিয়াছে। কী ভাবে রাজ্যের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ জিজ্ঞাসাবাদে ব্যাঘাত ঘটাইতেছেন, এবং ফলত বিধিসম্মত জিজ্ঞাসাবাদ-পদ্ধতিও অমান্য হইতেছে, সে দিকেও আদালত নির্দেশ করিয়াছে। কেবল তদন্ত প্রক্রিয়াতেই নয়, বেআইনি লগ্নি সংস্থা বিষয়ে রাজ্য সরকার যে সর্ব ক্ষেত্রেই ঢিলাঢালা চালে চলিতে আগ্রহী, তাহার প্রমাণ এই ধরনের কারবার সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের বিষয়টিও। কেন্দ্র হইতে কিছু সংশোধনের জন্য বিলটি রাজ্যে আসিবার পর তাহা আবার ফেরত পাঠাইতে প্রায় বৎসর ঘুরিয়া গেল। দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কিংবা দুর্নীতি, যাহাই এই অপারগতার হেতু হউক না কেন— ফলাফল: চূড়ান্ত ব্যর্থতা।
গোটা তদন্ত-পর্বে রাজ্যের পরাভবের পরে এখনও মুখ্যমন্ত্রীর বদান্যতায় রাজ্যের সম্মানহানির বন্দোবস্ত থামিয়া নাই। এত বিপুল সংখ্যক মানুষের এত বড় ক্ষতির পরে ক্ষমতাসীন সরকারেরই সেই ক্ষতির মোকাবিলায় বিশেষ ভাবে দায়বদ্ধ বোধ করিবার কথা। নিজের অপদার্থতা দিয়া সেই দায় ধুলায় মিশাইবার পর এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সিবিআই তদন্তে সহযোগিতার সুর নাই। অথচ, তাঁহারই বলিবার কথা ছিল যে, যে কোনও ভাবে তিনি সাহায্য করিতে, অন্যায়ের প্রতিকার করিতে প্রস্তুত। কিন্তু সতত স্পর্ধিত, সতত অনিয়ন্ত্রিত তাঁহার বাচনভঙ্গি। সেই ভঙ্গিতেই এই শেষ সুযোগটিও হারাইতে বসিয়াছেন তিনি। এই অদক্ষতা, অভব্যতা ও অধৈর্য দিয়া আর যাহাই হউক, রাজ্যকে উচ্চাসনে বসানো যায় না। রাজ্যের অধিকারের লড়াইও লড়া যায় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy