Advertisement
E-Paper

মতুয়া: শুধু শোরগোলই হবে? জানব না?

নির্বাচনী প্রচারের শোরগোলে সহসা মতুয়াদের কথা উঠে এল। অনেকে যোগ দিলেন সেই সওয়াল-জবাবে। কিন্তু, আগে একটু ইতিহাসটা জেনে নিলে ভাল হত বোধহয়। গৌতম চক্রবর্তী।এটাই কামনাসাগর। গুরুচাঁদ ঠাকুরের আবির্ভাবতিথিতে এখানে স্নান করলে পুণ্যলাভ। বাঁধানো পুকুর-ঘাট, পাশে শ্বেতপাথরের মন্দির। ভক্তদের লাইন। মন্দিরের পাশে দোতলা বাড়ি, গায়ে লেখা: নাটমন্দির। সেখানে হরির লুট। দু’জন বাতাসা ছুড়ে দিচ্ছে, লোকেরা কাড়াকাড়ি করে লুফে নিচ্ছে।

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৪ ০০:০০
ঐতিহ্য। মতুয়া মেলা। ঠাকুরনগর। মার্চ ২০১২। ছবি: পার্থসারথি নন্দী।

ঐতিহ্য। মতুয়া মেলা। ঠাকুরনগর। মার্চ ২০১২। ছবি: পার্থসারথি নন্দী।

এটাই কামনাসাগর। গুরুচাঁদ ঠাকুরের আবির্ভাবতিথিতে এখানে স্নান করলে পুণ্যলাভ। বাঁধানো পুকুর-ঘাট, পাশে শ্বেতপাথরের মন্দির। ভক্তদের লাইন। মন্দিরের পাশে দোতলা বাড়ি, গায়ে লেখা: নাটমন্দির। সেখানে হরির লুট। দু’জন বাতাসা ছুড়ে দিচ্ছে, লোকেরা কাড়াকাড়ি করে লুফে নিচ্ছে। মাইকে ভেসে আসছে কীর্তন, ‘মতুয়ারা দলে দলে ওড়াকান্দি যায়।’

ঠাকুরনগর। মতুয়া ধর্মাবলম্বীদের প্রধান কেন্দ্র। বছর দুয়েক আগে গিয়েছিলাম সেখানে। ছবিগুলি ফের মনে পড়ল সাম্প্রতিক ভোটনামচা দেখে ও শুনে। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নেতার বক্তব্য: মতুয়ারা রাজনীতির ফেরে এখনও নাগরিকত্ব পাননি। নাগরিকত্ব কি মতুয়া-অমতুয়া দেখে হয় নাকি? মতুয়ারা এক ধরনের ‘বৈষ্ণব’। দক্ষিণ ভারতের বৈষ্ণব অর্থে নয়, বাংলার নিজস্ব ধারার বৈষ্ণব বলতে যা বুঝি, সেই অর্থে। এর পর ‘বৈষ্ণবরা নাগরিকত্ব পাননি, শাক্তরা পেয়েছেন’ গোছের কথাও চলবে না কি?

তাই বলছি কী, ইতিহাসটি জানতে হবে। যুক্তির খাতিরে। কার মগজে মরুভূমি আর কার মরূদ্যান, সে সব কথাও অসার। রাজনীতি মানে শুধু সিপিএম, তৃণমূল আর বিজেপি নয়। অর্থনীতি, সামাজিক ইতিহাস সব মিলিয়ে বৃহত্তর এক পরিসর।

মতুয়ামেলায় দেখেছিলাম সেই পরিসরের চিহ্ন। নিশান উড়িয়ে ডঙ্কা বাজাতে বাজাতে ভক্তরা তখন ঝাঁপিয়ে পড়ছেন জলে। এই ভাবে কাড়ানাকাড়া বাজানো দুনিয়ার সর্বত্র কৃষক-বিদ্রোহের লক্ষণ। ডঙ্কা বা শিঙা মানেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজে নতুন এক ক্ষমতার জয়ঘোষণা: ‘আমি এসে গিয়েছি’। মতুয়া ধর্মেও কি রয়েছে নিম্নবর্ণের সেই বিদ্রোহের ছাপ?

এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলে মতুয়া ধর্মকে উপযুক্ত সম্মান দেওয়া হয় না, ইতিহাসও হারিয়ে যায় ডামাডোলে। গুজরাতের নেতার মতুয়া নিয়ে ধারণা না-থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বাঙালি প্রতিবাদীও গালিগালাজের বাইরে সারসত্য জানালেন না। জানার চেষ্টা করলেন না। শ্রীচৈতন্য, গ্রামবাংলার অন্ত্যজ কৃষক, নমশূদ্র সম্প্রদায়, সব মিলিয়ে মতুয়া ধর্ম বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য।

ধর্মটির প্রবর্তক হরিচাঁদ ঠাকুর। বাংলাদেশের সাফলডাঙা গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। ভক্তদের বিশ্বাস, শ্রীচৈতন্যই পরজন্মে হরিচাঁদ। মতুয়াদের ধর্মগ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’-র বয়ান, ‘নীচ হয়ে করিব যে নীচের উদ্ধার/ অতি নিম্নে না নামিলে কিসের অবতার?’ আর হরিচাঁদের পুত্র গুরুচাঁদ ছিলেন স্বয়ং শিব। পরিবারটি নমশূদ্র। মুখ্যত এই সম্প্রদায়ের মধ্যেই তাই মতুয়া ধর্মের বিস্তার।

বাঙালির জাতিবিভাজনে নমশূদ্র শব্দটি ঔপনিবেশিক অবদান। ১৮৮৫ সালের পর থেকে বাংলায় সত্‌চাষি, সদগোপ, নবশাখ ইত্যাদি নতুন জাতি-পরিচয় তৈরি হতে থাকে। নমশূদ্র শব্দটিও সেই সময়ে তৈরি। নাম যা-ই হোক, নমশূদ্রকে উচ্চবর্ণের মানুষ অন্ত্যজ বলে গণ্য করতেন। তাঁদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার ছিল না। এখান থেকেই আন্দোলনের মর্ম বুঝতে সুবিধে হয়। মন্দিরে যাঁদের প্রবেশাধিকার ছিল না, তাঁদের ধর্মগুরু শ্রীকৃষ্ণ আর শিবের অবতার। তাই ডঙ্কা বাজাতে বাজাতেই তাঁরা স্নানে যাবেন। উচ্চবর্ণের সঙ্গে নিম্নবর্ণের সংঘাত ও সমন্বয়ের যে রাজনীতি, তারই চিহ্ন ঠাকুরনগরে মহাস্নানে। মনে রাখবেন, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রধান লক্ষণ দুটি। এক, অবতারবাদ। যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি দেখা যাবে, ঈশ্বর মানুষ হয়ে জন্ম নেবেন। ইহুদি থেকে খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম কোত্থাও ভগবানের মানুষ হয়ে জন্মানোর নজির নেই। দুই, স্নান। গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, কাবেরীতে স্নান করে নিলেই আপনি পাপমুক্ত।

জমিদারের অত্যাচার, মিথ্যা মামলা দায়ের করার গল্প আছে হরিচাঁদের জীবনীতে। আবার আছে মরা মানুষ বাঁচিয়ে দেওয়া, অন্ধকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ার অলৌকিক ঘটনাও! সবাইকে সুস্থ, খুঁতহীন শরীর ফিরিয়ে দিচ্ছেন হরিচাঁদ। ফরিদপুর, বরিশালে বিপুল যে কৃষিজীবী অন্ত্যজ সম্প্রদায়, শরীরই তো তাদের সব! একটি কিংবদন্তি অনুসারে, ছোটবেলায় বাড়ির এক মরা গরুকে বাঁচিয়ে প্রথম ঐশী শক্তির প্রমাণ দেন হরিচাঁদ। একই কিংবদন্তিতে গরিব, অন্ত্যজ কৃষিজীবী সম্প্রদায়কে স্পর্শ করা গেল। গরু, হাল, বলদই তাদের অবলম্বন। এই কাহিনি গোঠের রাখাল কৃষ্ণের স্মৃতিও জাগিয়ে দেয় বইকী।

ঠাকুর হরিচাঁদের প্রবর্তিত এই মতুয়া ধর্মে বড় ভূমিকা আছে নামগানের। ‘হরি-ধ্যান হরি-জ্ঞান হরি-নাম সার/প্রেমেতে মাতোয়ারা মতুয়া নাম যার।’ অবশ্য মধ্যযুগের নিমাইয়ের থেকে হরিচাঁদের তফাতও আছে। নিমাই সন্ন্যাস নিয়েছিলেন, মতুয়া ধর্মের প্রবক্তার কাছে গৃহধর্ম খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘গৃহতে থাকিয়া যার ভাব উদয় হয়/ সে-ই পরম সাধু জানিয়ো নিশ্চয়।’ আজও ঠাকুরনগরের মেলায় ফকির বা সন্ন্যাসীর আখড়া নেই। মতুয়া ধর্মে শুধু বুধবার, হরিচাঁদের জন্মবারে নিরামিষ খেলেই হল। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটটি ভুললে চলে না মাছভাত যার প্রধান খাদ্য, সেই নমশূদ্র চাষিকে রোজ নিরামিষ খাওয়ার বিধান দেওয়া যায় কি?

নামগানের এই ধর্মকে আরও সুসংহত করলেন হরিচাঁদের পুত্র গুরুচাঁদ। সেটা ঘটল শিক্ষাবিস্তারের কারণে। পাটচাষের কারণে পূর্ববঙ্গের নমশূদ্র চাষির হাতেও তখন টাকা। এ দিকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ইংরেজি শিক্ষা। ঘুরে বেড়াচ্ছেন মিশনারি ও ব্রাহ্ম প্রচারকেরা। গ্রামের নমশূদ্র চাষিও তখন বোঝেন, শিক্ষা ছাড়া কিছু হওয়ার নয়। তাই গুরুচাঁদের বাণী, ‘প্রয়োজন হলে করবে ভিক্ষা/ ছেলেমেয়েকে দেবে শিক্ষা।’ বামুন, কায়েত, বদ্যিরা শুধু হায়ার কাস্ট নয়, ‘হায়ার কালচার’ও। যোগ দিতে হবে সেই সংস্কৃতির পরিসরে।

বছর দুয়েক আগের সেই মেলায় দেখছিলাম, ‘মতুয়া ধর্মাদর্শমতে ক্রিয়াকর্মের বিধান’ নামে একটি চটি বই। সেখানে নির্দেশ, বিয়ের সময়ও দেখতে হবে পাত্রপাত্রীর ‘এডুকেশন’। নিম্নবর্গের আর কোনও ধর্ম শিক্ষায় এত গুরুত্ব দিয়েছে কি? মেলা দেখতে দেখতে একটা ব্যাপার তাই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল কেন স্বাধীনতার পর পূর্ববঙ্গের নমশূদ্র উদ্বাস্তু এ পারে এসে বগুলা, মাজদিয়া যেখানেই বাসা বাঁধতেন, চাঁদা তুলেও স্কুল, কলেজ গড়ার চেষ্টা করতেন। ধর্মের বিধান।

শিক্ষাবিস্তারের কারণেই ইংরেজ আমলে ওকালতি, অধ্যাপনায় ঢুকে পড়ছিলেন নমশূদ্ররা। কিন্তু পেতে হবে সরকারি চাকরি। তাই দর কষাকষি করতে হল, ব্যবহার করতে হল রাজনীতির পাঞ্জা। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাল সময়ে গুরুচাঁদ পূর্ববঙ্গ ও অসমের ছোটলাটকে এক অভিনন্দনপত্র দেন। গুরুচাঁদের পৌত্র প্র

ভোট-রাজনীতির ঢের আগে, উনিশ শতক থেকে বাঙালি নিম্নবর্ণের প্রতিবাদী রাজনীতি নিহিত মতুয়া ধর্মে। আমরা খেয়াল করি না।

post editorial goutam chakraborty motua
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy