বিশ্বজোড়া সন্ত্রাস রাজত্বে যাঁহাদের দশা সর্বাপেক্ষা মন্দ, তাঁহারা হইলেন সন্ত্রাসধ্বস্ত মুসলিমরা। পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশে বৃহস্পতিবার বিখ্যাত সুফি পীঠস্থান লাল শাহবাজ কালান্দরের মারাত্মক বিস্ফোরণে যে এক শত জন নিরীহ ধর্মভীরু মুসলিম প্রাণ হারাইলেন, তাঁহারা এই দুর্ভাগ্যজনক সত্যটিই আর এক বার স্পষ্ট করিলেন। ইঁহারা মুসলিম হইয়াও মুসলিম ধর্মের অতিরক্ষণশীলদের কালান্তক ক্রোধের লক্ষ্য। আবার উল্টা দিকে অমুসলিম বিশ্বের সহানুভূতিও ইঁহারা যথেষ্ট পরিমাণ পান না, কেননা ইঁহারা মুসলিম বিশ্বের নাগরিক, এবং সাধারণত কোনও-না-কোনও সংকট-মথিত মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিক। বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে তাঁহাদের স্থান খুবই সামান্য। যদি কোনও অমুসলিম দেশে জঙ্গি মুসলিম হানায় এক শত জন মারা যাইতেন, তাহা হইলে ইতিমধ্যে বিশ্বময় শোরগোল পড়িত। কিন্তু সুফিদের মৃত্যুতে, বিশেষত পাকিস্তানি সুফিদের মৃত্যুতে শোরগোল তুলিবার কেহ নাই। গত দশ বৎসরে পাকিস্তানের কতগুলি সুফি ধর্মস্থানের উপর আঘাত নামিয়া আসিয়াছে তাহার হিসাব করা কঠিন হইবে। প্রথমে পাখতুন অঞ্চলে, ক্রমে পঞ্জাব ও সিন্ধু, উভয় প্রদেশে মুসলিম উগ্রপন্থীরা ইঁহাদের ধর্মে কর্মে ও ধনে প্রাণে বিনাশ করিয়া চলিয়াছে। কিন্তু পাকিস্তানের সুফি সমাজে বিপন্নতা লইয়া সরব সচেতনতা কই? সিরীয় উদ্বাস্তুদের দুর্ভাগ্যের কথা যদিও বা কিছু লোক জানে শোনে, সুফি সম্প্রদায় যে শেষ হইতে বসিয়াছে, এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক সচেতনতা আজও অতি স্বল্প।
সাধারণত এই ধরনের আক্রমণের দায় তালিবানরা লইলেও এ বারের ঘটনার পরই আই-এস বা ইসলামিক স্টেট তড়িঘড়ি দায়স্বীকার করিয়াছে, যদিও পাকিস্তানে আই-এস গোষ্ঠীটি এখনও তেমন শক্তপোক্ত নয়। তবু কেন দায় স্বীকারের এই তাড়া? কারণটি খুবই পরিষ্কার। এই স্বীকারের মধ্যে এক মহা গৌরব আছে। সুফি সংস্কৃতির মধ্যে সহনশীলতার মন্ত্র আছে, ধর্মসমন্বয়ের আহ্বান আছে, শান্তির অঙ্গীকার আছে। আই-এস বা তালিবানের মতো উগ্রপন্থীরা এইগুলিকে ইসলামবিরোধী প্রতিপন্ন করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে। সুফিবাদ যে ইসলামেরই একটি অংশ, এক গোষ্ঠীর ইসলামিরা সেই সত্য মুছিয়া দিতে প্রতিশ্রুত হইয়াছে।
ইহার মধ্যে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ যে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই সন্ত্রাসের নিন্দা করিয়াছেন, ইহাই একমাত্র আশ্বাসজনক সংবাদ। তাঁহার নিন্দাবাক্যর সঙ্গে কিছু সরকারি সক্রিয়তাও যুক্ত হইবে, এই প্রত্যাশা রহিল। গত পাঁচ দিনে এই লইয়া আটটি সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিল। পাক সরকারের পক্ষে অত্যন্ত উদ্বেগজনক ঘটনা। অবশ্য কেবল পাক সরকার কেন, পারমাণবিক অস্ত্রসম্পন্ন কোনও রাষ্ট্রের অন্দরে এই পরিমাণ সন্ত্রাসকাণ্ড প্রত্যহ ঘটিয়া যাইতেছে, তাহা গোটা দুনিয়ার পক্ষেই উদ্বেগের কথা। যে দুইটি গোষ্ঠী এই ঘটনার দায়ের সঙ্গে ইতিমধ্যে নিজেদের জড়াইয়া প্রকাশ্য ঘোষণা করিয়াছে, সেই জামাত-উর-আহরার (অন্যতম পাক তালিবান গোষ্ঠী) এবং ইসলামিক স্টেট— এখনই তাহাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ লওয়া উচিত। তাহাদের নিষিদ্ধ করা উচিত। উপযুক্ত তদন্তের ভিত্তিতে তাহাদের সাংগঠনিক অস্তিত্ব বিনষ্ট করা উচিত অথচ প্রধানমন্ত্রী যাহাই বলুন, পাকিস্তানের সরকার উচিত কাজ করিবার জন্য আজও পরিচিত নহে। সমস্যার মূলটি ঠিক এইখানেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy