Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

যেতে পারি, কেন যাব

তুই সিঁথি যেতে চাইলে বলব নাকতলার দিকে আমার গাড়ির নাক, নাকতলা যেতে চাইলে বলব সিঁথিই আমার গাড়ির সিঁদুর।ট্যাক্সির রং আগে ছিল হলদে-কালো। হঠাত্‌ হল পুরো হলুদ। এখন আবার মার্কেটে এসেছে নীল-সাদা। এই হড়বড় চেঞ্জাচেঞ্জির মধ্যে একটা তো জিনিস থাকবে, যেটা অটল, পাহাড়-টাইপ গ্যঁাট। সেইটা হল আমাদের ব্যবহার, আমাদের অ্যাটিটুড। চিরকাল ‘মারব নাকি একখান রদ্দা!’

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

ট্যাক্সির রং আগে ছিল হলদে-কালো। হঠাত্‌ হল পুরো হলুদ। এখন আবার মার্কেটে এসেছে নীল-সাদা। এই হড়বড় চেঞ্জাচেঞ্জির মধ্যে একটা তো জিনিস থাকবে, যেটা অটল, পাহাড়-টাইপ গ্যঁাট। সেইটা হল আমাদের ব্যবহার, আমাদের অ্যাটিটুড। চিরকাল ‘মারব নাকি একখান রদ্দা!’ পোজে পৃথিবী দাবড়ে এসেছি, এখনও দাবড়াব। মিটারে র্যান্ডম কারচুপি করব, কলার ধরে একশো আটানব্বই টাকা খুচরো আদায় করব তবু নিজের ট্যঁাক থেকে দু’টাকা খুচরো খসাব না, সেকেন্ডে সেকেন্ডে অ্যায়সা মেজাজ দেখাব যেন পৃথিবীকে শট কষানো আমার জন্মগত অধিকার। আমাদের গাড়িতে উঠতে গেলে, মাথা নিচু করে উঠতে হয়। সিলিংটা যে একটু লো হাইটে রেখেছি, সিম্বলিক।

আসলে, আমাদের বুঝতে গেলে, পেশার স্পিরিটটাকে বুঝতে হবে। অন্য পুঁজি-চাটা বেওসার সঙ্গে তুলনাই হয় না। আমাদের মূল কাজ টাকা রোজগার নয়, নো, আমাদের মিশন হল, সারা কলকেতা ঘুরে বেড়ানো, তোমাকে দেখলে একটু স্লো হওয়া, আর যেই না বলেছ, ‘ওখেনে যাবেন?’ তক্ষুণি মাথাটি ঘ্যাটঘ্যাট করে নেড়ে স্পিডে বেরিয়ে যাওয়া। ওই যে তোমার মুখটা ‘এই বার ভবানীপুর যাব’ ভেবে ব্রাইট হয়েছিল, আর আমার সপাট প্রত্যাখ্যানটিতে আমসির মতো চুপসে গেল, শুধু এই চকিত লোডশেডিংটি দেখার জন্যে আমরা মাইল মাইল টহল মারি। তুই সিঁথি যেতে চাইলে বলব নাকতলার দিকে আমার গাড়ির নাক, নাকতলা যেতে চাইলে বলব সিঁথিই আমার গাড়ির সিঁদুর। আমি যেতে চাই না, পয়সা চাই না, জ্ঞান চাই না, ভক্তি চাই না। শুধু রিফিউজ করতে চাই, ‘না’ বলতে চাই। একমাত্র ডাকসাইটে সুন্দরীরা এর মর্ম বুঝবে।

সেডিজ্ম বা ধর্ষকাম বহু প্রকার। কেউ আমোদ পাওয়ার জন্যে বউকে খুন্তিছ্যাঁকা মারে, কেউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প গড়ে ইহুদি জাতটাকেই দগ্ধে মারতে চায়। কিন্তু ধরা পড়লে এ 498A খেয়ে শ্রীঘরে, ও হিস্ট্রির চ্যাপটারে চির-ভিলেন। এ দিকে আমরা টর্চারের অ্যায়সা ছদ্ম-তরিকা নিয়েছি, এটা যে একটা সেডিস্ট কাল্ট, কেউ আন্দাজ অবধি পারে না। আমাদের ম্যানিফেস্টো: মানুষকে ছিঁচকে ইরিটেশনের বড়ি দিনভর গিলিয়ে যাও। অসহায় লোকের ফ্রাস্টেশন চাখো, ব্যস্ত লোককে দেরি করিয়ে মারো, হাসপাতালে এয়ারপোর্টে ইন্টারভিউয়ে সিনেমাশোয়ে প্রেমঅ্যাপোয় সময় কাঁচিয়ে দাও। গোটা সমাজটাকে খুঁচিয়ে, চুলকে, চিমটি মেরে, বিছুটি টপকে খেপচুরিয়াস করে ছাড়ো। এই মুঠো মুঠো মেন্টাল ছারপোকা ছড়ালে, ক-বাবু বাড়ি ফিরে বাচ্চাটার কান মুলে মামাবাড়ি দেখাবে, খ-বাবু অফিস গিয়ে অধস্তনকে যাচ্ছেতাই ঝাড়বে। চরাচরে একটা ছিমছাম ছোবল-ছটফট ছলকাবে।

এই সাধনা কিন্তু গেব্লে যাবে, যদি না গুরুভাইদের মধ্যে অসামান্য ঐক্য ঘটে। অফিস ছুটির পরে লোকে রাস্তায় উপচে দাঁড়িয়ে আকুল হাত দেখাচ্ছে, তাদের নাকের ডগা দিয়ে সটাসট গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার যে প্লেজার—মুখ থুবড়ে পড়বে যদি তোমারই ট্রাইবের একটি মেম্বার ফট করে দাঁড়িয়ে বলে, ‘উঠুন’। কত মনের তেজে, কী পেল্লায় সংযমে আমাদের এই কামারাদারি তৈরি করতে হয়, যাতে দু’হাজার গাড়ি ওই রাস্তায় পাস করবে, কেউ দাঁড়াবে না! না, সবাই পারে না, কারও কারও হার্ট দুর্বল, চরিত্র লতানে। একটা মা হয়তো বাচ্চাকে নিয়ে নাজেহাল দাঁড়িয়ে, ইস্কুল থেকে ফিরতি পথে বাচ্চাটা ঘেমে নেতিয়ে কাত। তখন মূল মস্তিটা কী? ওদের ভিড়বাসের দিকে ঠেলে দেওয়া, ভিড়-মেট্রোয় ঝুলতে চ্যাপটাতে বাধ্য করা, কিংবা ‘গোটা রাস্তা কদম কদম বড়ায়ে যা রে ব্যাটা’ চাঁটা লাগানো, এই তো? অনেকে এই পারপাসটাই না বুঝতে পেরে আমাদের প্রফেশনের অপমান করে। দাঁড়িয়ে যায়। কেউ কেউ তো এমন মেনিমুখো, কোথায় যাবেন অবধি জিজ্ঞেস করে না, বিনা আপত্তিতে প্যাসেঞ্জার নিয়ে নেয়। আশ্রম খোল না, ব্যাটা সাধু! তবে এরা খুচখাচ কলঙ্ক, সব চাঁদেই থাকে। মেজরিটি জোছনার কিছু এসে যায় না।

শুধু ‘না’ বলে ভাগালে অবশ্য ভ্যারাইটি কমে যায়। তাই কখনও হুংকার বানাই, যাব, কিন্তু মেন রোডে ছাড়তে হবে। যেন আমি একটা আখাম্বা বাস, এ গতর লয়ে গলিতে ঢুকতে পারি না। তা-ও যদি মেনে নাও, ফেরত ছ’টাকা কিছুতে দেব না। চাইলে, টিটকিরি মারব, কিপটের জাসু! পরের ভাড়াটা নিয়ে গাঁতিয়ে বোঁ বোঁ চালাব, ঝাঁকুনি লাগাব। সবাইকে ওভারটেক করতে চাইব, হর্ন মারব ঝালাপালা। বিরক্ত হলে, হ্যঁাচকা চেল্লাব, আপনার কাছ থেকে শিখব, গাড়ি চালানো? আর টাইম বুঝে তো অবশ্যই হাঁকব, কুড়ি টাকা, একস্ট্রা। তিরিশ। রাতের দিকে, একশো টাকাও। সে রকম বুঝলে, মিটারে যাবই না। একটা অ্যামাউন্ট বলে দেব। যাবি তো চ, নইলে পচে মর। কী করে সাড়ে এগারোটায় সল্ট লেক ফিরতে পারিস, দেখে নেব।

হ্যাঁ, কিছু প্যাসেঞ্জার থাকে ঘাউড়া টাইপ। সবাই তো ভদ্রতা শেখে না। ক্যাচড়া পাকায়, কেউ কেউ হাসায়ও, বলে ‘থানায় নিয়ে যাব।’ আবার অনেকে ‘নো রিফিউজাল’ লেখা দেখে সহসা ইংরিজিকে বিশ্বাস করে ফ্যালে। তখন ধৈর্য ধরে বাছাই খিস্তি বা চড়াস থাবড়া মেরে সবক শেখাতে হয়। মাঝরাস্তায় ঘাড় ধরে নামিয়ে দেওয়া বা চলন্ত গাড়ি থেকে ঠেলে ফেলার পদ্ধতিও হ্যাজ। তাও যদি না মানো, সত্‌ পরিশ্রমী লোকগুলোকে শুধু শুধু রাগিয়ে দাও, বেস্পতিবার রাতে যা হয়েছে তা-ই হবে: পেটে খচাত্‌ ক্ষুর! সারা রাত ফুর্তি করে ট্যাক্সি চড়ে বেড়াবে, তার পর মিটারে যা উঠেছে তা-ই দেবে? ন্যাকামি? সমঝে চোলো ভাই, অ্যায়সা মস্তানি, সরকার অবধি আমাদের দেখলে মিনমিনিয়ে নখ খোঁটে! না তো কী করবে? ত্যান্ডাই দেখলেই তো তক্ষুনি স্ট্রাইক! হিঃ, মনে রেখো, এই শর্মাদের স্ট্রাইক রেট রোহিত শর্মার ডবল! জেনো, কলকাতা লন্ডনালে, আমরা ক্যাব হব, তোমরা ক্যাবলাই রয়ে যাবে!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial taxi kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE