Advertisement
১১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

যে ভাবে ‘মানুষ’ করছি

জীবনে সব ধরনের মানুষের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে গেছে। তাই একটা মানুষকে পিটিয়ে মেরে দেওয়া যায়, কারণ সে ‘আমাদের মতো’ নয়। লিখছেন বোলান গঙ্গোপাধ্যায়।নিষ্ঠুরতা, নির্মমতায় আশ্চর্য হওয়া আজ কঠিন। তবু, ১৬ নভেম্বর সকালে হাসপাতালের ছাত্রাবাসে দু’ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে কোরপান শাহকে খুন করার ঘটনাটা জানতে পেরে আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছি। ঘটনার আকস্মিকতায় যতটা, তার থেকেও বেশি বোধহয় খুন করার পদ্ধতি ও কারণের জন্য।

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

নিষ্ঠুরতা, নির্মমতায় আশ্চর্য হওয়া আজ কঠিন। তবু, ১৬ নভেম্বর সকালে হাসপাতালের ছাত্রাবাসে দু’ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে কোরপান শাহকে খুন করার ঘটনাটা জানতে পেরে আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছি। ঘটনার আকস্মিকতায় যতটা, তার থেকেও বেশি বোধহয় খুন করার পদ্ধতি ও কারণের জন্য। অভিযোগ, এক দল ছেলে তাদেরই কাছাকাছি বয়সের একটি ছেলেকে চোর সন্দেহে দু’ঘণ্টা ধরে নানা ভাবে পিটিয়ে মেরেছে। এবং দেখেছি, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে, হয়তো তাদেরই কেউ যখন এই খুনকে ‘রাগ তো হতেই পারে’ বলে খানিকটা যেন সাফাই দিচ্ছে! আমাদের মেধাবী ছেলেরা সমস্ত শিক্ষা-যুক্তি-বুদ্ধি-মানবিকতার পাঠ শিকেয় তুলে রেখে কী ভাবে এমন হিংস্র হয়ে উঠতে পারে? রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া, প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা— এই সব তো আছেই। কিন্তু তার চেয়েও গভীর একটা প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই।

আমাদের সমাজের, বিশেষ করে নাগরিক মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের কেমন করে বড় করে তোলা হয়েছে, তারা কী ভাবে নিজেদের এবং চারপাশকে দেখছে, তাদের জীবনবোধ ও মূল্যবোধ কেমন ভাবে তৈরি হচ্ছে? এখানে গত কয়েক দশকে একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। নিজেদের অতীতের দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখতে পাই, সেই বড়দের আঙুল ধরে স্কুলে যাওয়ার বয়স থেকেই কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের বৃত্তে থাকত নানা শ্রেণির শিশু। অনাথ আশ্রমের মেয়েদের সঙ্গে সঙ্গে নামকরা ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়েরা ছিল আমার সহপাঠী। আজ বুঝি, সমাজবোধ তৈরি হয়েছে গিয়েছে সেই সময়েই। কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা বলছি না, যদিও সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমি শুধু বলছি ছোটবেলা থেকে দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে দিয়ে সব ধরনের মানুষের সঙ্গে একটা সংযোগ গড়ে ওঠার কথা। সেই সংযোগটাই এখন অনেকাংশে হারিয়ে গেছে।

এটা এক দিনে হয়নি। বামফ্রন্ট প্রাথমিক থেকে পাশ-ফেল আর ইংরেজি তুলে দেওয়ার পর থেকেই স্কুলের শ্রেণিবিভাজন বাড়তে থাকে। এখন আর সাধারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরা সরকার পরিচালিত স্কুলে তেমন যায় না, তাদের জন্য বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। আর গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের জন্য সস্তার বাংলা স্কুল। বিভাজন শুধু স্কুলেই হল না, অভিভাবকের মানসিকতাতেও তার ছাপ পড়ল। ছাপ পড়ল পড়ার অভ্যাসে। গরিবদের জন্য পাড়ার এক চিলতে মাঠ বা পার্ক বরাদ্দ, আর অন্যরা ক্রিকেট ব্যাট বা টেনিস র্যাকেট নিয়ে খেলা শিখতে গেল। যারা ইংরেজি স্কুলে গেল, তাদের অভিভাবকরা ধরেই নিলাম যে সবাই এক নম্বর হবে। সংখ্যার বিচারে এই এক নম্বররা তুলনায় কম, কিন্তু গুরুত্বে তারাই বেশি, কারণ তারাই এক দিন হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশাসন, সওদাগরি অফিসের মাথা হয়ে বসবে। নীতি নির্ধারণও তারাই করবে। অথচ দেশের ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস, কিছুর সঙ্গেই তাদের পরিচয় ঘটে না। সম্পূর্ণ কৃত্রিম একটা জগতের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে বসে থাকে তারা।

স্কুলে, বাড়িতে, খেলার মাঠে কেবল এক নম্বর হওয়ার প্রতিযোগিতা। এমন হলে বন্ধুরা আর সহমর্মী থাকে না, প্রতিপক্ষ হয়ে যায়। আনন্দের উপকরণ আর ভাণ্ডার ছোট হতে হতে কেবল প্রতিযোগিতার সাফল্যে এসে দাঁড়ায়।আমরাই তো বিচ্ছিন্ন নিরাপত্তার বলয়ে সন্তানদের আত্মোন্নতির সাধনায় মগ্ন রাখতে চেয়েছি। বন্ধু, ভাই, প্রতিবেশী, কারও জন্য ভাবতে শেখাইনি। কারও দুঃখ-সুখ ভাগ করে নিতে বলিনি। তার মাসুল গুনছি। ভয় হয়, আরও অনেক গুনতে হবে।

একটাই আশা। এই ঘটনার প্রতিবাদ এসেছে সমাজেরই মেধাবী ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে, যারা এই প্রতিযোগিতায় থেকেও, নিজেদের আর পাঁচ জন সাধারণের থেকে আলাদা সারিতে দাঁড় করায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar post editorial bolan gangopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE