নিরপেক্ষতা রাজধর্মের প্রথম শর্ত। দুনিয়ার সমস্ত রাজত্বেই সেই শর্ত অল্পবিস্তর লঙ্ঘিত হইয়া থাকে। রামরাজ্যেও একশো শতাংশ নিরপেক্ষতা পালিত হইত, এমন কোনও প্রমাণ নাই। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শাসিত পশ্চিমবঙ্গে ধর্মচ্যুতির লক্ষণগুলি যেন অস্বাভাবিক রকমের প্রকট। তাঁহার পূর্বসূরি বামফ্রন্টের প্রশাসনের পক্ষপাত লইয়া অজস্র অভিযোগ ছিল, বিশেষত প্রশাসনের চালকরা শাসক দলের অঙ্গুলিহেলনে কী ভাবে দিনকে রাত এবং রাতকে দিন করিতেন, তাহার বিস্তর নমুনা ক্রমাগত তুলিয়া ধরা হইত। কিন্তু সেই ধারার পরিবর্তন দূরস্থান, তাহারই আরও উৎকট এবং স্থূল রূপ বর্তমান জমানায় উন্মোচিত হইয়া চলিয়াছে। সম্প্রতি দুইটি ঘটনায় প্রশাসনের যে দুই ধরনের আচরণ দেখা গিয়াছে, তাহা পরস্পরের এমনই বিপ্রতীপ যে, শুনিলে কল্পিত কাহিনি বলিয়া মনে হইতে পারে। আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়ের বিরুদ্ধে পুলিশ যে ভাবে সক্রিয় হইয়াছে এবং সারদা কেলেঙ্কারির সূত্রে অভিযুক্ত সুদীপ্ত সেনের স্ত্রী ও পুত্রকে গ্রেফতারির ব্যাপারে পুলিশ যে ভাবে নিষ্ক্রিয় থাকিয়াছে, তাহা আলাদা করিয়া দেখিলে বিস্ময়কর, পাশাপাশি রাখিয়া দেখিলে অবিশ্বাস্য।
কোনও প্রার্থী মদ্যপ অবস্থায় বা সশস্ত্র ভাবে নির্বাচনী প্রচারে ব্রতী হইলে নিশ্চয়ই আইনানুগ ব্যবস্থা বিধেয়, আইনের চোখে প্রতিটি নাগরিকই সমান। কিন্তু সেই কারণেই বিপরীত শিবিরের প্রার্থী বলিয়া কাহারও অকারণ হেনস্থা অনুচিত। বাবুল সুপ্রিয়ের ক্ষেত্রে পুলিশ তেমন অনুচিত আচরণ করিয়াছে, এই অভিযোগ প্রবল এবং তাহাকে অসংগত বা অহেতুক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া কঠিন। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডের প্রসঙ্গে ‘সাজানো ঘটনা’র যে অভিযোগটি তুলিয়াছিলেন, বাবুল সুপ্রিয়ের ক্ষেত্রে পুলিশের আচরণ সম্পর্কে সেই অভিধাটি অত্যন্ত উপযোগী বলিয়া মনে করিবার পক্ষে আনুষঙ্গিক সাক্ষ্যপ্রমাণ রীতিমত প্রবল। আনুষঙ্গিক সাক্ষ্য অবশ্যই অকাট্য প্রমাণ নহে, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ধারণা অপেক্ষা তাহার গুরুত্ব বোধহয় সামান্য বেশি। কোন ঘটনাকে সাজানো মনে করিবার কোনও কারণ নাই এবং কোন ঘটনার বিবরণ জানিলেই সাজানো বলিয়া প্রবল সংশয় হয়, তাহা সচরাচর বোঝা কঠিন নয়।
এই প্রেক্ষিতেই সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তপ্রক্রিয়া তাৎপর্যপূর্ণ। শুরু হইতেই এই তদন্তে রাজ্য প্রশাসন এবং পুলিশের ভূমিকা লইয়া বহু অভিযোগ। যথা, যথেষ্ট তৎপর এবং নিরপেক্ষ ভাবে তদন্ত চালানো হইতেছে না, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বাছিয়া বাছিয়া আটক বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হইতেছে, কিছু কিছু ‘ক্ষমতাবান’ ব্যক্তিকে আড়াল করা হইতেছে। অবশ্যই এই সকলই অভিযোগ, কিন্তু বিভিন্ন দিক হইতে যখন একই ধরনের অভিযোগ ওঠে, তখন সংশয়ের কারণ থাকে যে, অভিযোগগুলি উড়াইয়া দেওয়ার নয়। তাহার উপরে, যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের রাজ্যের পুলিশ দিনের পর দিন ‘খুঁজিয়া পাইতেছিল না’, কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট যখন তাঁহাদের দিব্য খুঁজিয়া বাহির করিয়া ফেলে, তখন এই বিষয়ে সন্দেহ জাগিবেই যে, পুলিশ তাঁহাদের সত্যই খুঁজিয়াছিল কি না। এই সন্দেহ বাড়তি মাত্রা পায়, যখন রাজ্যের শাসক দলের প্রভাবশালী রাজনীতিক বা মন্ত্রীদের ভূমিকা লইয়াও প্রশ্ন দেখা দেয় এবং সেই প্রশ্নের জবাবে তাঁহারা যে সমস্ত উক্তি করেন তাহাকে পাশ কাটাইয়া যাইবার ছল বলিয়া মনে হয়। অথচ রাজধর্ম দাবি করে, বিরোধী দলের ভোটপ্রার্থী এবং সরকারের মন্ত্রী, উভয়েই আইনের চোখে সম্পূর্ণ সমান। অভিধানে বোধহয় একটি নূতন শব্দ যুক্ত করা আবশ্যক। রাজ-অধর্ম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy