নেহরু তখন প্রধানমন্ত্রী। সংসদে একদা প্রবল বাগবিতণ্ডা হয় নেহরুর সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা পি সুন্দরাইয়ার। উপরাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণন তখন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে যে লেডি মাউন্টব্যাটেন দিল্লি আসছেন। কিছু দিন থাকবেন। সেটা নিয়ে রাজ্যসভা উত্তাল। দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে। এখনও লেডি মাউন্টব্যাটেনের কীসের স্বার্থ? সুন্দরাইয়া তো আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, “লেডি মাউন্টব্যাটেন কি আসলে আসছেন নেহরুর সঙ্গে দেখা করতে!” এই মন্তব্যে নেহরু তো রেগে অগ্নিশর্মা। উত্তাল সংসদ।
কিন্তু পরে রাধাকৃষ্ণন ফোন করেন সুন্দরাইয়াকে। উপরাষ্ট্রপতির বাসভবনে বিকেলে চায়ের আসর। সুন্দরাইয়ার আমন্ত্রণ। নেহরু নিজে আসবেন।
রাধাকৃষ্ণন বলেন, “আসলে লেডি মাউন্টব্যাটেনের বিষয়ে তিনি সংবেদনশীল। ওই নামটা ওঠায় তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন।” সে দিন সুন্দরাইয়া যান চা-চক্রে। নেহরুও আসেন। সুন্দরাইয়াকে দেখেই এগিয়ে এসে করমর্দন করেন নেহরু। কমিউনিস্ট নেতা নেহরুকে বলেন, “আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমার বোধহয় এ ভাবে এতটা ‘ওভাররিঅ্যাক্ট’ করা উচিত হয়নি।” নেহরুও সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, “আমারও এত রেগে যাওয়া অনুচিত হয়েছে। আমিও ক্ষমাপ্রার্থী।” কাজেই মধুরেন সমাপয়েৎ। সংসদের হাঙ্গামা দু’পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কত সহজে নিরসন হয়ে গেল!
সে দিন আর আজ। কত ফারাক, তাই না! রাজনীতিতে মতামতের ফারাক থাকতেই পারে। ব্যক্তিগত আক্রমণ অতীতে যে সংসদে কখনও হয়নি তা-ও নয়। কিন্তু আজ সংসদে দিনের পর দিন ধরে যে অচলাবস্থা চলে তা দেখে মনে হয়, রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, আসলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে ‘ইভেন্ট’ তৈরি করতে ব্যস্ত রাজনৈতিক দল ও নেতারা।
এখন সংসদে বিরোধী দল কাকে বলে? বিরোধী দল সে, যার কাজ শুধুই বিরোধিতা করা। শাসক দলের কাজ বিরোধী দলকে প্রতিহত করা। বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন প্রধান বিরোধী দল ছিল কংগ্রেস। তখন বাজপেয়ী সরকার বিমা বিলের বেসরকারিকরণ করতে তৎপর হয়েছিল। তখন বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত নিতেও অরুণ জেটলি আর অরুণ শৌরির মতো মন্ত্রীরা ছিলেন সক্রিয়। তখন বিজেপি সরকারের বিরোধিতা করেছে কংগ্রেস। আবার মনমোহন সিংহ যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন পরমাণু চুক্তি থেকে বিমা বিল— বিজেপি তীব্র বিরোধিতাই করেছে। সে সময়ে আডবাণীকে একদা ফোন করেন কংগ্রেসের লোকসভার নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রণববাবু বিল পাশ করার ব্যাপারে বিজেপি-র সমর্থন চান। কিন্তু বিরোধী দলনেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী সে দিন প্রণববাবুকে বলেছিলেন, “আমরা যখন ক্ষমতায় ছিলাম, তখন তো আপনারা আমাদের বিল পাশ করতে কোনও সাহায্য করেননি। আজ আমরা করব কেন?”
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্থলসীমান্ত চুক্তি পাশ করার ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত বিজেপি রাজি হয়নি। মনে আছে, তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ অনেক বার অনুরোধ করেছিলেন আডবাণী ও সুষমা স্বরাজদের। সে সময়ে বিজেপি-র অসম ইউনিটের বিরোধিতার যুক্তিতে বিজেপি সে বিলের বিরোধিতা করে। তখন বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর আমাকে বলেছিলেন, “এমন কোনও বিল সংসদে আমাদের পাশ করতে দেওয়া উচিত নয় যেখানে কংগ্রেসের লাভ হতে পারে।”
সে দিন আর আজ? আজ বিজেপি ক্ষমতাসীন। নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেই সীমান্তচুক্তি পাশ করাচ্ছেন। এখন মোদি-অমিত শাহ চাইছেন যাতে বিলটি পাশ হয়। তাই অসমের বিজেপি ইউনিটকেও এই মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন কত সহজে এই বিলটি পাশ হয়ে যাচ্ছে।
এ বার লোকসভার অধিবেশনের শুরু থেকেই কালো টাকার বিষয় নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস সক্রিয়। তৃণমূল কংগ্রেস আক্রমণাত্মক। এমনকী, সংসদের সেন্ট্রাল হলে অন্য দলের সাংসদেরা তো অনেকেই বলছেন যে, মনে হচ্ছে মমতাই যেন প্রধান বিরোধী দল। মমতা নিজে সংসদে শারীরিক ভাবে উপস্থিত নন, কিন্তু কলকাতা থেকেই তিনি তৃণমূল সাংসদদের হাঙ্গামা, বিক্ষোভ প্রদর্শন— সবই নিয়ন্ত্রণ করছেন।
এখন সংসদে বিতর্কের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব পায় বিক্ষোভ, হাঙ্গামা। সংসদের মেঝেতে এসে বিক্ষোভ দেখানো তো এখন কোনও নতুন ঘটনাই নয়। এটাই স্বাভাবিক। শুধু সংসদ কেন, রাজ্যে রাজ্যে আইনসভাগুলিরও অবস্থা তথৈবচ। মায়াবতী তখন মুখ্যমন্ত্রী। মনে আছে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় বিধায়কদের সেই তাণ্ডবনৃত্য! মাইক ভেঙে এক জন আর এক জনকে আঘাত হানছে। সে সময়ে কেশরীনাথ ত্রিপাঠী ছিলেন বিধানসভার স্পিকার, যিনি এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল। অনেক বিধায়ক মার খাওয়ার ভয়ে তো বেঞ্চের নীচে গিয়ে লুকিয়েছেন! পৃথিবীর নানা প্রান্তে সংসদের ভিতরে মারামারি যে হয় না তা নয়। কিন্তু ভারতের মতো এক বিশাল গণতান্ত্রিক দেশে সংসদের ভূমিকার এই রূপান্তর দীর্ঘ দিন ধরেই হয়ে চলেছে।
নীতি বা আইন প্রণয়নের চেয়ে সংসদের বাইরে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা ঘরে তোলার জন্যই যেন বেশি ইচ্ছুক দলগুলি। বেশি তৎপর। সমাজতাত্ত্বিক আন্দ্রে বেতেই বলেছেন, সংসদে শাসক দল ও বিরোধী দলের মধ্যে আসলে থাকে ‘পলিটিক্যাল সিম্বাওসিস’, বাংলায় বলা হয় ‘রাজনৈতিক মিথোজীবীতা’।
একটা দেশের উন্নয়ন ও বিকাশের মডেল সফল হতে পারে যদি এই মিথোজীবীতা থাকে। সংসদ মানেই শুধু হাঙ্গামা? অবশ্য এ বারের অধিবেশনে বিমা বেসরকারিকরণ বিলের সমর্থনে কংগ্রেসের সহযোগিতার আশ্বাস অথবা ছিটমহল হস্তান্তর চুক্তির সম্ভাব্য সংসদীয় অনুমোদন দেখে কিঞ্চিৎ আশার আলো জেগেছে। সংখ্যালঘু বা জোট সরকারের এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অনেক বেশি হয়, এখন তো নরেন্দ্র মোদীর সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপি সরকারের কাণ্ডারী। তাই সংসদে বিল পাশের সম্ভাবনা বেশি, তবে রাজ্যসভায় বিজেপি এখনও সংখ্যালঘু। তাই বিল পাশ নিয়ে কিছু সমস্যাও আছে। রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই বলে বিজেপি সরকার যৌথ অধিবেশন ডেকে বিল পাশ করাবে কি না সেটাও দেখার।
বিজেপি কী রণকৌশল নেবে, সেটা বিজেপি-র ব্যাপার। কিন্তু আদর্শ পরিস্থিতি হল, সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছনো!
—ফাইল চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy