জাপানে, ২২ জন শিক্ষক জাতীয় সংগীত গাহিতে অস্বীকার করায়, শাস্তি হিসাবে, পুনরায় নিয়োগের জন্য আর তাঁহাদের নাম বিবেচনা করা হয় নাই। ছাত্রছাত্রীদের স্নাতক উপাধি প্রদান করিবার অনুষ্ঠানে, উঠিয়া দাঁড়াইয়া জাতীয় সংগীত গাহিবার রীতি, কিন্তু এই শিক্ষকেরা তাহা করিতে চাহেন নাই। কোনও কোনও সমালোচক বলেন, জাপানের জাতীয় সংগীতে দেশের রাজার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের কথা বলা আছে এবং উহা সামরিকবাদ উদযাপন করে। হয়তো উহাই শিক্ষকদিগের মূল আপত্তি। ১৯৯৯ সাল হইতে জাপানে প্রায়ই জাতীয় সংগীতকে কেন্দ্র করিয়া কিছু শিক্ষকের সহিত রাষ্ট্রের সংঘাত ঘটিতেছে। কখনও কোনও শহরের মেয়র ইঁহাদের ‘অপরাধী’ বলিয়া দাগিয়া দিতেছেন, কখনও প্রধানমন্ত্রী বলিতেছেন: জাতীয় সংগীতকে গুরুত্ব দিতে হইবে, ইহা তো স্বাভাবিক ধারণা। ২০০৩ হইতে অদ্যাবধি ৪১৩ জন শিক্ষক কেবল এই সংগীতকে অবমাননার দায়েই দণ্ডিত হইয়াছেন। কোনও ছাত্র বা ছাত্রী জাতীয় সংগীতের ‘অপমান’ করিলেও, তাহার শিক্ষকদিগকে শাস্তি পাইতে হয়। প্রতিটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এই ধরনের কড়া অনুশাসন আছে, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলিয়াছেন, এই নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও বলবৎ করা প্রয়োজন। অথচ এক অভূতপূর্ব রায়ে, গত সোমবার এক জেলা আদালতের বিচারক রায় দিলেন, এই ২২ জন শিক্ষকের প্রতি অন্যায় হইয়াছে এবং তাঁহাদের মোট ৫৩৭ মিলিয়ন ইয়েন (সাড়ে চার মিলিয়ন ডলার) ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে। এক উল্লসিত শিক্ষক জানাইয়াছেন, এই রায় বহু মানুষকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বার্তা দিবে।
ভারতে বেশ কিছু মাস পূর্বে হইহই পড়িয়াছিল, এক নামজাদা মহিলা এক ভদ্রলোককে সিনেমা হল-এ চড় কষাইয়া দেন, তিনি জাতীয় সংগীতের সময় উঠিয়া দাঁড়ান নাই বলিয়া। এই লইয়া তর্কে অনেকেই বলেন, কিছু কিছু অনুশাসনকে অস্বীকার করিবার অধিকার নাগরিকের থাকিতে পারে না। অর্থাৎ, এই দেশে থাকিয়া এই দেশের জাতীয় সংগীতের ভাবনার সহিত এক নাগরিকের বিশ্বাস না-ই মিলিতে পারে, বা সে এই জাতিকেই তেমন শ্রদ্ধা না করিতে পারে— ইহা অনেকেরই নিকট অগ্রহণযোগ্য। অথচ নাগরিকের একটি মৌলিক অধিকার হইল, দেশ বা জাতির প্রতি অশ্রদ্ধা লালন করা, বা মনে করা, এই দেশ তাহাকে যথোপযুক্ত সম্মান দিতেছে না, ফলে সেও তাহাকে ফিরিয়া সম্মান করিতে বাধ্য নহে। জাতীয় সংগীতকে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন, বা, বিধিবদ্ধ সম্মান প্রদর্শন করিতে অস্বীকার, বাক্স্বাধীনতারই অঙ্গ। সমালোচনার অধিকারের অঙ্গ। ইহার শাস্তি দিতে শুরু করিলে, প্রধানমন্ত্রীর কার্টুন আঁকিলেও শাস্তি দিবার দিন আসিতে বিলম্ব হইবে না। অবশ্য অসীম ত্রিবেদী (সঙ্গের ছবিতে) যে কার্টুন আঁকিয়াছিলেন, তাহা লইয়া বৎসর আড়াই পূর্বে এই গোত্রেরই আলোড়ন হইয়াছিল। তাঁহার কার্টুনের কোনওটিতে পার্লামেন্ট হইয়া যায় কমোড, কোনওটিতে ভারতমাতাকে গণধর্ষণে উদ্যত হয় ‘দুর্নীতি’। রাষ্ট্র তাঁহাকে গ্রেফতার করে, যদিও পরে প্রবল প্রতিবাদের ফলে মুক্তি দেওয়া হয়। এই দণ্ডদানের প্রবণতার মূলে যে অসহনশীলতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, তাহাই কিন্তু মৌলবাদের ভিত্তি। তাহার অন্য প্রকাশও পৃথিবীতে ইদানীং প্রবল। বাংলাদেশে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ব্লগ লিখিলেই সেই লেখককে রাজপথে কচুকাটা করিবার প্রকল্প গ্রহণ করিয়াছে মৌলবাদীরা। সম্প্রতি ‘এই বার তোর পালা’ মর্মে তাহারা হুমকি দিল অনন্য আজাদ নামে ব্লগারকে, তিনি এখন আত্মরক্ষার্থে হেলমেট পরিয়া পথে হাঁটিতেছেন। তাঁহার পিতা হুমায়ুন আজাদকেও হত্যার চেষ্টা হইয়াছিল, তাঁহার রহস্যজনক মৃত্যুকে অনেকেই হত্যা মনে করেন। অনন্য ভাবিতেছেন, দেশ ছাড়িবেন। জাপান যাইবার চেষ্টা করিতে পারেন, অন্তত এক জন মুক্তমনা বিচারক সেখানে রহিয়াছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy