আপাতদৃষ্টিতে যাহা অবশ্যকর্তব্য বলিয়া বোধ হয়, কূটনীতির বিচারে তাহা নিতান্তই অকর্তব্য বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে। এই বিরোধে আপাতদৃষ্টির দোষ নাই, কূটনীতিরও নহে। সাম্প্রতিক কালে ইউক্রেন বনাম রাশিয়ার বিরোধ যেমন। গোটা পশ্চিম দুনিয়া যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে এককাট্টা হইয়াছিল, ভারত তখন দূর হইতে ‘পরিস্থিতির দিকে নজর রাখিতেছিল’। বারাক ওবামা যখন হোয়াইট হাউসে বসিয়া রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিতেছিলেন, ভারত তখন ইউক্রেনে ‘রাশিয়ার নীতিসঙ্গত স্বার্থের’ কথা মনে করাইয়া দিয়াছিল। পশ্চিমি চশমা লাগাইয়া ভারতের অবস্থান বিচার করিতে বসিলে পক্ষপাতিত্বের পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ কিছু তীব্রই ঠেকিবে। প্রত্যয় হইবে, ভারত রুশ সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন জোগাইয়াছে। কাহার নিকট কখন কোন সাম্রাজ্যবাদ গ্রহণযোগ্য হয়, কখন ভিন্ রাষ্ট্রে সেনা পাঠাইয়া নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটাইয়া গণতন্ত্র রক্ষা করা হয়, সেই প্রশ্নগুলি আপাতত থাকুক। ইউক্রেন-রাশিয়া প্রশ্নে ভারতের অবস্থানের পক্ষে একটি কথা বলাই যথেষ্ট হইবে— এই প্রশ্নে পশ্চিম দুনিয়া আর ভারতের স্বার্থ ভিন্ন, ফলে কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিবেকের ভূমিকা লওয়া যে কূটনীতির উদ্দেশ্য হইতে পারে না, এই কথাটি ভারত নেহরু যুগে বহু মূল্যে শিখিয়াছে। কূটনীতির একমাত্র লক্ষ্য সর্বাপেক্ষা কুশলী ভাবে দেশের স্বার্থ— মূলত অর্থনৈতিক স্বার্থ— রক্ষা করা। পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলিও সেই কাজই করিয়াছে। তাহাদের নিকট ইউক্রেনের বাজারটিকে রাশিয়ার কবল হইতে উদ্ধার করিয়া নিজেদের জন্য উন্মুক্ত করিয়া লওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের নিকট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাশিয়ার নৈকট্য। যখন বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া কোণঠাসা, তখন আরও বেশি করিয়া। রাশিয়া ঐতিহাসিক ভাবে ভারতের ঘনিষ্ঠ বলিয়া নহে, অর্থনীতির যুক্তিতে। পশ্চিমের বাজার সাময়িক ভাবেও বন্ধ হইলে রাশিয়া পূর্ব দিকে তাকাইবে। সেই অভিমুখে সর্বাপেক্ষা লোভনীয় বাজারটি ভারতে। রুশ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি এই বাজারের অংশ দখল করিতে চাহিবে। ফলে, ক্রেমলিনও দিল্লির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করিতে চাহিবে। এই রুশ ঘনিষ্ঠতা হইতে ভারতের অনেক কিছু পাওয়ার আছে। সেই প্রাপ্তির সম্ভাবনা নষ্ট করা অপরিণতমনস্ক কূটনীতির পরিচায়ক হইবে। ভারত সেই পথে হাঁটে নাই।
ইস্পাত হইতে পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস; সামরিক পরিকাঠামো হইতে উন্নত প্রযুক্তি বা পারমাণবিক শক্তি— রাশিয়া ভারতকে অনেক কিছুই দিতে পারে। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে প্রভূত বিনিয়োগও পাওয়া সম্ভব। সবই ভারতের পক্ষে লাভজনক। কিন্তু তাহারও অধিক জরুরি একটি বৃহৎ আর্থিক শক্তির নৈকট্য। এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে স্পষ্ট, সব অর্থেই চিনের প্রতিস্পর্ধী একমাত্র ভারত। ফলে, চিনের সহিত অম্লমধুর সম্পর্কটির স্বাদে মাঝেমধ্যেই যে অম্লরসের আধিক্য ঘটে, তাহা ভবিষ্যতেও থাকিবে। সেই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনকে ছাড়িয়া ভারতের পিছনে সর্বশক্তিতে দাঁড়াইবে, এমন প্রত্যাশা অমূলক। চিনের সহিত যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সম্পর্ক অনেক বেশি গভীর। ঠিক সেই কারণেই রাশিয়াকে ভারতের প্রয়োজন। সেই সম্পর্কটিকে যথেষ্ট গভীর করিতে চাহিলে গোড়ায় অর্থনীতির সার ঢালিতেই হইবে। ইউক্রেনের বিবাদ ভারতকে সেই সুযোগ করিয়া দিয়াছে। কূটনীতি তাহার কতখানি সদ্ব্যবহার করিতে পারে, তাহাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy