Advertisement
০৭ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

সূর্য থাকতে মোমবাতি কেন

সূর্য থেকে যে শক্তি আসে, তা আমাদের প্রয়োজনের অনেক বেশি। অথচ জ্বালানির সংকট বাড়ছেই। দরকার গবেষণার, যাতে মানুষের কাছে সৌরশক্তি সহজে পৌঁছে দেওয়া যায়।এই গরম দেশে বছরের বেশির ভাগ সময় রৌদ্রের কোনও অভাব নেই। তাই সৌরশক্তি সম্বন্ধে গবেষণা এবং মানুষ যাতে সেই শক্তির ব্যবহার করতে পারেন সেটা অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে আমরা বাড়িতে সম্পূর্ণ নিজেদের সামর্থ্যে কিছু জিনিস করতে পেরেছি। এক নম্বর, ঘরে আলো। যেখানে সরকারি বিদ্যুতের ঘাটতি আছে, সেখানে সৌরশক্তির সাহায্যে আলোর ব্যবস্থা করা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সৌর প্যানেল থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ দিয়ে একটি বড়সড় ব্যাটারি চার্জ করা হয়। কিন্তু তা সাধারণ ঘরের কাজে ব্যবহারের নানান সমস্যা আছে।

শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় ও পার্থসারথি মজুমদার
শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

এই গরম দেশে বছরের বেশির ভাগ সময় রৌদ্রের কোনও অভাব নেই। তাই সৌরশক্তি সম্বন্ধে গবেষণা এবং মানুষ যাতে সেই শক্তির ব্যবহার করতে পারেন সেটা অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে আমরা বাড়িতে সম্পূর্ণ নিজেদের সামর্থ্যে কিছু জিনিস করতে পেরেছি।

এক নম্বর, ঘরে আলো। যেখানে সরকারি বিদ্যুতের ঘাটতি আছে, সেখানে সৌরশক্তির সাহায্যে আলোর ব্যবস্থা করা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সৌর প্যানেল থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ দিয়ে একটি বড়সড় ব্যাটারি চার্জ করা হয়। কিন্তু তা সাধারণ ঘরের কাজে ব্যবহারের নানান সমস্যা আছে। একটা বিকল্প হল, সৌর প্যানেল থেকে পাওয়া ১২ ভোল্ট ডিসি বিদ্যুৎ দিয়ে সরাসরি ছোট ১২ ভোল্ট, ৭ থেকে ৯ অ্যাম্পিয়ার-আওয়ার, এলইডি-অ্যাসিড ব্যাটারিকে আধানযুক্ত করা যেতে পারে এবং তা দিয়ে ১২ ভোল্ট ডিসি ‘লেড’ জ্বালানো যেতেই পারে। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, আলোকসজ্জায় ব্যবহৃত চিনে ওয়ার্ম হোয়াইট এলইডি-র যে মালা বাজারে পাওয়া যায়, তা দিয়ে একটা চল্লিশ থেকে ষাট ওয়াট বাল্বের মতো আলো অনায়াসে পাওয়া যায়। কড়া রোদে চার-পাঁচ ঘণ্টায় ব্যাটারি ঠিক মতো আধানযুক্ত করা হলে এই আলো রাতে প্রায় পাঁচ-ছ’ঘণ্টা বেশ ভাল জ্বলে, তার পর আস্তে আস্তে তেজ কমে আসে। খরচ? একটা ১২ ভোল্ট ৫০ ওয়াট সৌর প্যানেলের দাম আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। ভাল এলইডি অ্যাসিড ব্যাটারির দামও ওই রকমই। চিনে এলইডি মালা খুব বেশি হলে চার-পাঁচশো। মোটামুটি হাজার ছয়েক টাকা প্রথমে খরচ করলে বিনা মূল্যে ঘরে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা হয়ে যায়। কত দিন চলে সে ব্যবস্থা? তা প্রায় বছর দুই তো বটেই।

দুই, গরম জল। আমরা ডিসি হিটার এলিমেন্ট নিয়ও কিছু পরীক্ষা করেছি। একটা কালো রম করা ধাতব জলাধার, তার মধ্যে দুটো তার ঢোকানো, যেগুলো ২৪ ভোল্টের একটা ব্যাটারি প্যাকের সঙ্গে লাগানো। ব্যাটারি প্যাকটি আগে থেকে সৌরশক্তিতে চার্জ করে রাখা যায়। জলাধারটি দু’লিটার আয়তনের হলে শীতকালেও জল পঞ্চাশ-ষাট ডিগ্রি সেলসিয়াস অবধি গরম করতে কুড়ি থেকে ত্রিশ মিনিটের বেশি সময় লাগা উচিত নয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে প্রায়ই গরম জলের দরকার হয়, অথচ অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্যুৎ থাকে না, সেখানে এই ব্যবস্থা খুব কাজে আসতে পারে। আর একটা কথা। এই যন্ত্রে ২২০ ভোল্টের যন্ত্রের মতো শক লাগার কোনও সম্ভাবনা নেই।

তিন, যানবাহন। সাধারণত ব্যাটারি চার্জ করে সৌরশক্তি সঞ্চয় করা হয়। কিন্তু খুব বেশি বার রিচার্জ করা যায় না, সময়ও লাগে অনেক। আবার, কাজ ফুরিয়ে যাওয়ার পরে দূষণের কারণে ব্যাটারি যেখানে সেখানে ফেলা যায় না। এই সব কারণে তৈরি হয়েছে সুপারক্যাপাসিটর, যার ক্ষমতা সাধারণ ক্যাপাসিটরের তুলনায় অনেক বেশি। এগুলি রাসায়নিক দিয়ে তৈরি নয়, সাধারণত কার্বন দিয়ে ন্যানোপ্রযুক্তিতে তৈরি হয়। এর প্রযুক্তি এমন নয় যে এ দেশে তৈরি করা যায় না, কিন্তু এখনও এগুলি আমেরিকা, জার্মানি বা চিনের মতো দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এই সুপারক্যাপাসিটরের বহু প্রয়োগ রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এদের আবির্ভাবে ভবিষ্যতে ব্যাটারির ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রয়োগের মধ্যে একটা হচ্ছে যানবাহনের কাজে। আমরা সুপারক্যাপাসিটরকে সৌরশক্তি সঞ্চয়ের আধার হিসেবে ব্যবহার করে ট্রাম, ট্রেন, সাইকেল রিকশ ও ফেরি নৌকোর প্রোটোটাইপ বানিয়েছি। সবই খেলনা মাপের, কিন্তু একই পদ্ধতি ব্যবহার করে পূর্ণ মাপের তৈরি করতে বাধা নেই। প্রথমে খরচ হবে, কিন্তু তার পর অনেক দিন নিখরচায় যানবাহন চলবে।

বছরের বেশির ভাগ সময় রিকশা-চালকদের কষ্টের সীমা থাকে না। আমাদের মডেলটি কাজে লাগালে সেই কষ্ট অনেক লাঘব হবে। এখন শহরতলিতে ‘টো-টো’ বলে একটা ব্যাটারিচালিত রিকশা ভালই চলছে। কিন্তু দাম অনেক, তার ওপর বেশির ভাগটাই চিনা, ফলে খারাপ হলে মুশকিল। এর বিকল্প হিসেবে, দেশে তৈরি করা যায় এবং খারাপ হলে সারানো যায়, এমন একটা সৌরশক্তিচালিত রিকশা তৈরি করতে পারি আমরা। খরচ কম রাখার জন্য প্রথমে সুপারক্যাপাসিটরের বদলে সৌরশক্তি দিয়ে চার্জ করা ব্যাটারি দিয়ে চালিয়ে দেখা যেতে পারে। টো-টো’র মতো জোরালো ৪৮ ভোল্ট ব্যাটারির বদলে ১২ বা ২৪ ভোল্ট দিয়ে চালানো যায়। আর, দেশে এত বড় বড় ন্যানোল্যাব হয়েছে, সুপারক্যাপাসিটর তৈরি করে এই যানগুলির পূর্ণ পরীক্ষানিরীক্ষা করা সম্ভব হবে না কেন?

প্রতিদিন সূর্য থেকে যে পরিমাণ শক্তি পৃথিবীতে এসে পড়ে, তা সারা বছরে আমরা সমস্ত দেশ মিলে যা শক্তি খরচ করি তার চেয়েও অনেক বেশি। সূর্য থেকে শক্তি সংগ্রহ করে গাছপালা, অন্য প্রাণী বহু কাল দিব্যি বেঁচে রয়েছে। কিন্তু আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি এমন সব জ্বালানির ব্যবহারে যেগুলি সহজলভ্য নয়, কিংবা অতি ব্যয়সাধ্য এবং বিপজ্জনক। সৌরশক্তির উপযোগিতা আজ সকলের কাছেই স্পষ্ট। এখন দরকার গবেষণার, যাতে সাধারণ মানুষের কাছে সেই শক্তি সহজে পৌঁছে দেওয়া যায়। যখন ভাবি, আমাদের দেশে পারমাণবিক শক্তির গবেষণায় যত খরচ হয়েছে, সৌরশক্তির জন্য তার এক শতাংশও হয়নি, তখন অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। ‘ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া’র এত জয়ধ্বনি, অথচ সৌরশক্তি ও বিকল্প শক্তির গবেষণায় এত পিছিয়ে রয়েছি যে, অন্য দেশে তৈরি সুলভ সৌর প্যানেলের সমকক্ষ কোনও প্যানেল এ-যাবৎ তৈরি করে উঠতে পারলাম না। পাছে ব্যবসার ক্ষতি হয়, সে জন্য দেশের সৌর প্যানেল বিক্রেতারা বিদেশে তৈরি প্যানেলের উপর কর বসানোর জন্য সরকারের কাছে দরবার করছেন!

এত রোদ যে দেশে, সেখানেও কেন দরিদ্র কোনও স্কুল-পড়ুয়াকে মোম বা কেরোসিনের আলোয় পড়তে হবে, তা বোঝা কঠিন।

শেখরবাবু ইলেকট্রনিক্স বিশেষজ্ঞ, পার্থসারথিবাবু বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE