একটি বিষয়ে ভারত সহজেই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সেরাদের মধ্যে স্থান পাইবার যোগ্য। কত দ্রুত কত বেশি সংখ্যক আইন পাশ করানো যায়, সেই পরীক্ষায়। সম্প্রতি গুজরাতে যে সংরক্ষণ বিল পাশ হইল অ-সচ্ছল উচ্চবর্ণের জন্য, তাহা কেবল বিষয়ের দিক হইতে লক্ষণীয় নয়, দ্রুততা এবং দ্রুততা-ঘটিত অবিবেচনার জন্যও উল্লেখ্য। সে রাজ্যে পটেলদের প্রবল আন্দোলন দেখা গিয়াছে, তাঁহারা নিম্নবর্ণের পাশাপাশি উচ্চবর্ণের জন্যও চাকুরিক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণ দাবি করিয়াছিলেন। সেই আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছাইয়াছিল যে নেতাদের ধরিয়া জেলে পোরা ছাড়া গতি ছিল না। কিন্তু আগুনের আঁচ তাহাতে নিবে নাই। এ দিকে বিধানসভা নির্বাচনের কাল সমাগতপ্রায়। বিজেপি-শাসিত রাজ্যে তড়িঘড়ি উচ্চবর্ণ-প্রসাদ-প্রার্থনায় সুতরাং সংরক্ষণ ঘোষিত। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গঠন করিবার পর এই লইয়া পর পর তিনটি রাজ্যে এই ভাবে উচ্চবর্ণকে সংরক্ষণের আওতায় আনা হইল: রাজস্থান, হরিয়ানা, গুজরাত। বিজেপির তত্ত্বাবধানে দেশে সংরক্ষণের অর্থ ও তাৎপর্য কেবল পাল্টাইতেছে না, ডিগবাজি খাইতেছে। আইনপ্রণয়নকারীদের সমর্থকরা নিশ্চয়ই উদ্দিষ্ট ভোটের ভারা পূর্ণ করিয়া দিবেন, কিন্তু দেশের সংবিধান নীরবে নিভৃতে কাঁদিতেছে সন্দেহ করিলে ভুল হইবে না।
স্বাভাবিক। কেননা এই নূতন আইনে সংরক্ষণ নামক ব্যতিক্রমী প্রথাটির মূল দর্শন ও ইতিহাস দুইটিই অতিক্রম করা হইল। সংবিধান-কর্তারা ঐতিহাসিক ভাবে পশ্চাৎপদ জনসমাজকে কিছু অতিরিক্ত সুযোগ দিবার স্পষ্ট সামাজিক লক্ষ্য লইয়াই এই প্রথার প্রচলন করিয়াছিলেন। তাহাও সাময়িক ভিত্তিতে চালু করিবার কথাই ভাবিয়াছিলেন। তাঁহারা ভাবেন নাই, অতঃপর একে একে সমস্ত জাতি-গোষ্ঠী-শ্রেণির জন্য, এমনকী ঐতিহাসিক ভাবে সকল সুযোগসুবিধাপ্রাপ্ত উচ্চবর্ণ সমাজের জন্যও ইহা প্রযুক্ত হইবে। মুড়ি-মিছরি তফাত না করিয়া সবাইকে টুকরো টুকরো শতাংশ উপহার হিসাবে ধরাইয়া দেওয়া হইবে। সংবিধানে বলা আছে, সর্বোচ্চ সংরক্ষণের পরিমাণ হইতে পারে ৪৯ শতাংশ। গুজরাত রাজ্য সরকার তাহাতে কর্ণপাতও করে নাই। ৪৯-এর উপরে আরও ১০ অবলীলায় বাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে সুবিধাভোগীদের আরও সুবিধা দিবার জন্য। সংখ্যা ও তত্ত্ব দুই দিক দিক দিয়াই সংবিধান অমান্য করিবার এই প্রবণতা গোটা দেশের জন্য অতি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হইয়া রহিল।
১৯৯৯ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানাতেও রাজস্থানে জাঠদের সংরক্ষণের মধ্যে লইয়া আসিবার জন্য তাহাদের ‘ওবিসি’র বর্গে ঢুকাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। এই গোষ্ঠীর নাম দেখাইয়া সংরক্ষণ-ক্ষেত্রে অনেক অন্যায়ের আমদানিই নব্বইয়ের দশক হইতে চলিতেছে, কিন্তু সরাসরি উচ্চবর্ণের অন্তর্ভুক্তি করিয়াও বাজপেয়ী সরকার দেখাইয়া দিয়াছিল, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক তথ্য নেহাতই মায়া। তাহাই সত্য, যাহা রচিবে রাজনীতি। গুজরাতে এই মুহূর্তে এই রাজনীতিকে বলা হইতেছে ললিপপ রাজনীতি, যে পতিদাররা ইহাতে সর্বাধিক উপকৃত হইবেন বলিয়া ধরা যায়, তাঁহারাই এই নাম দিয়াছেন, কেননা তাঁহারা অধিকতর ও ব্যাপকতর উপকার আশা করিয়াছিলেন! আশা একটিই। আদালত অবধি এই সংরক্ষণ মামলা গড়াইবার সম্ভাবনা প্রবল, এবং সে ক্ষেত্রে অসাংবিধানিকতার অভিযোগে আইনটির পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনা প্রবলতর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy