Advertisement
১৭ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

সবাই অপছন্দ, গণতন্ত্রে এটাও একটা পছন্দ

এ বারের লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ৬০ লক্ষ ভোটার ‘নোটা’য় ভোট দিয়েছেন। সংখ্যাটা বড় কথা নয়, অপছন্দের কথাটা বুথে গিয়ে জানিয়ে আসার অধিকারটা গণতন্ত্রে খুব মূল্যবান। সুকান্ত সরকারসদ্য সমাপ্ত ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে দেশের ৬৬.৪ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। লক্ষণীয়, এ বার ভোটে আর সে ভাবে ভোট বয়কটের ডাকও শোনা যায়নি, সাড়াও দেয়নি কেউ। বরং, একটা ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ভাল সাড়া পেয়েছে। এ বার লোকসভা নির্বাচনে প্রথম বার ‘কোনও প্রার্থীকেই (পছন্দ) নয়’ বা নোটা (NOTA: None of the Above) বোতাম টেপার সুযোগ দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। সদ্য শেষ হওয়া ভোটে দেখা যাচ্ছে, কম-বেশি সব আসনেই নোটা’কে বেছে নিয়েছে অনেক ভোটার।

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৪ ০০:১৮
Share: Save:

সদ্য সমাপ্ত ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে দেশের ৬৬.৪ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। লক্ষণীয়, এ বার ভোটে আর সে ভাবে ভোট বয়কটের ডাকও শোনা যায়নি, সাড়াও দেয়নি কেউ। বরং, একটা ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ভাল সাড়া পেয়েছে। এ বার লোকসভা নির্বাচনে প্রথম বার ‘কোনও প্রার্থীকেই (পছন্দ) নয়’ বা নোটা (NOTA: None of the Above) বোতাম টেপার সুযোগ দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। সদ্য শেষ হওয়া ভোটে দেখা যাচ্ছে, কম-বেশি সব আসনেই নোটা’কে বেছে নিয়েছে অনেক ভোটার। সারা দেশে প্রায় ৬০ লক্ষ বা ১.১ শতাংশ ভোটার এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। অনুপাতটা সিপিআই বা জেডিইউ-এর প্রাপ্ত ভোটের থেকে বেশি। এমনকী গুজরাতের বডোদরা কেন্দ্রে, যেখানে নরেন্দ্র মোদী রেকর্ড ভোটে জিতেছেন, সেখানেও কিন্তু কয়েক হাজার ভোটার পছন্দ করেছে নোটা-কে। গুজরাতের ২৬টি কেন্দ্রেই জয়ী হয়েছে বিজেপি। কিন্তু, গোটা রাজ্যে নোটার আশ্রয় নিয়েছেন ৪ লক্ষ ৪০ হাজার ভোটার (১.১%)। পশ্চিমবঙ্গেও সাড়ে ৫ লক্ষের (১.৮%) কিছু বেশি ভোট পড়েছে নোটায়। দেশের প্রায় সর্বত্রই সংরক্ষিত কেন্দ্রগুলিতেও বহু সংখ্যক ভোট পড়েছে নোটার পক্ষে।

শতাংশের দিক থেকে দেখলে পুদুচেরিতে সর্বাধিক (৩ শতাংশ) ভোটার নোটায় ভোট দিয়েছেন। তামিলনাড়ুতে নোটায় সব চেয়ে বেশি ভোট পড়েছে, নীলগিরি কেন্দ্রে, ৪৬ হাজারের বেশি। মাওবাদী অধ্যুষিত ছত্তীসগঢ়ের বস্তার বা ওড়িশার নবরঙপুর কেন্দ্রেও এত বেশি ভোট পড়েনি নোটায়। ওড়িশার নবরঙপুর কেন্দ্রের মাও-অধ্যুষিত মালকানগিরিতে নোটাকে ব্যবহার করেছেন ৪৪ হাজারের বেশি মানুষ। তার পরেই বস্তার। নোটার ঘরে পড়েছে প্রায় ৩৯ হাজার ভোট। নোটা সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছে লক্ষদ্বীপে, ১২৩টি।

এ রাজ্যে বিভিন্ন প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষের অনেকেই নোটায় ভোট দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে যৌনকর্মী থেকে শুরু করে বনবাসী-জনজাতিদের অনেকে রয়েছেন। লোকসভা ভোটে এ বার সারা দেশে প্রায় ১০ লক্ষ যৌনকর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বুথে গেলেও কোনও প্রার্থীকেই ভোট দেননি বলে দাবি যৌনকর্মীদের বিভিন্ন সংগঠনের। আগেই ঠিক করে নিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই এ বার নোটার বোতাম টিপবেন। তার কারণ, সরকার যৌনকর্মীদের পেশাকে স্বীকৃতি দেয়নি, আজও চলছে হয়রানি, পুলিশি হেনস্থা। ‘অনেক নেতা সোনাগাছিতে এসেছেন ভোটের প্রচারে, কখনও বা ভাইফোঁটা নিতে। নানা রকমের অনুষ্ঠানেও এসেছেন শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা। সবাই গদগদ হয়ে আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে গেছেন ব্যক্তিগত ভাবে যৌনকর্মীদের তাঁরা শ্রমিক-ই মনে করেন। কিন্তু আইন মদত করছে না বলেই তাঁরা কিছু করে উঠতে পারছেন না।’ বললেন সোনাগাছির এক যৌনকর্মী। দেশের ১৬টি রাজ্যের যৌনকর্মীদের ১১১টি সংগঠনের যৌথ মঞ্চ ‘অল ইন্ডিয়া সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক’ নোটায় ভোট দেওয়া ডাক দিয়েছিল। ওই সংগঠন আশা করেছিল, তাদের ডাকে প্রায় সমস্ত যৌনকর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্য সব মিলে প্রায় ৫১ লক্ষ ভোটার নোটায় ভোট দেবে। শেষ অবধি কত জন সেই ডাকে সাড়া দিয়েছেন, সেটা গবেষণাসাপেক্ষ, কিন্তু অন্তত একটা সাড়া পড়েছে।

দেশের বনাঞ্চলের উপর বনে বসবাসকারী মানুষের অধিকার সংক্রান্ত আইন ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের বনাঞ্চলে আজ পর্যন্ত ওই আইনটি লাগু করেনি রাজ্য সরকার। বনাধিকার আইনে বলা রয়েছে, বন পরিচালনার প্রয়োজনে গ্রামের মানুষ পঞ্চায়েতের সাহায্যে গ্রামসভা বানিয়ে, তার মাধ্যমে বন ও বন্যপ্রাণীর রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। কৃষিজমি ও বাস্তুজমির উপরে মালিকানার অধিকার পাবেন বনবাসীরা। বনবস্তিগুলিকে খাস জমিতে রূপান্তরিত করে ‘রাজস্ব গ্রাম’ তৈরি করার কথা বনাধিকার আইনে বলা থাকলেও তা কোথাও কার্যকর করা হয়নি। উত্তরবঙ্গের সমস্ত বনবস্তিকে রাজস্ব গ্রামে রূপান্তরিত করা, সুন্দরবনে বনাধিকার আইন চালু করা, জঙ্গলমহল-সহ রাজ্যের অরণ্যনির্ভর মানুষের হাতে জমির অধিকার দিতে এবং বনাধিকার আইন কার্যকর করতে কোথাও আদিবাসী-অনাদিবাসী ভেদাভেদ করা চলবে না বলে বনবাসী-জনজাতিরা দাবি জানিয়ে আসছেন বহু দিন ধরে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। তাই এ বার বনবাসীরা-জনজাতিদের একটি বড় অংশ নোটায় ভোট দিয়েছেন।

কট্টর বামপন্থীরা মনে করেন, এটা রাষ্ট্রের একটা চাল। সমাজব্যবস্থা বদলের জন্য নাগরিকরা যাতে অন্য কোনও পথে না যান, সে দিকে তাকিয়েই নোটা। ‘সেফটি ভাল্ভ’। এই যুক্তি উড়িয়ে দেওয়ার নয়। তবে সেটাও গণতন্ত্রের কৃতিত্বই!

বস্তুত, সংসদীয় গণতন্ত্রকে মজবুত করতে নোটার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ভোট বয়কটের রাস্তায় গেলে সরাসরি সংসদীয় গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়। যাঁরা বয়কট করেন তাঁরা মানসিক ভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রের বাইরে থেকে যান। কী ভাবে এই প্রবণতা রোখা যায় তা নিয়ে বিস্তর মাথা ঘামিয়েছেন সংসদীয় গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক অনেক মানুষ। যে সব জায়গায় ভোট বয়কটের ডাক দেওয়া হত সেখানে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আখেরে ভাল ফল পাওয়া যায়নি।

এখানেই নোটার একটা ভূমিকা থাকতে পারে। যে সব সংগঠন এত দিন ভোট বয়কটের ডাক দিত তাদের অনেকেই নোটাকে ব্যবহার করতে চেয়েছে অন্য অর্থে। বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করে, এমন সংগঠনগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি সংগঠন বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে উৎসাহিত করেছে নোটায় ভোট দিতে, সব দলের প্রার্থীকে নাকচ করতে। তাদের বক্তব্য, কোনও দল বা প্রার্থী ভোটে জেতার পর তাদের জন্য কিছু করেনি কোনও দিন। তাই প্রত্যাখ্যান। যে সব দল ভোটের সময় নিয়ম করে ভোট বয়কটের কথা বলে থাকে সেই সব দলের বেশির ভাগই এ বার সমাজ বদলের জন্য নোটায় ভোট দেওয়ার ডাক দিয়েছিল।

তাই বলতেই হয়, কত শতাংশ মানুষ নোটায় ভোট দিলেন, তার চেয়েও অনেক বড় প্রশ্ন হল, কেন তাঁরা নোটায় ভোট দিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sukanta sarkar nota
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE