Advertisement
E-Paper

সব জীবন নয় সমান

অর্থনীতির ছাত্ররা বলিবেন, কোনও পণ্যের জোগান বাড়িলে তাহার দাম কমে। ভারতীয় রাজনীতিকদের দেখিলে আশঙ্কা হয়, তাঁহারা বুঝি অর্থনীতির এই প্রাথমিক পাঠটিকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়া বসিয়াছেন। তাঁহারা বুঝি পণ্যের নিয়মকে মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ভাবিয়াছেন। সেই সমীকরণ বলিবে, ভারতে যেহেতু মানুষের সংখ্যা প্রচুর, অতএব এক জন সাধারণ ভারতবাসীর প্রাণের দাম এক জন সাধারণ ইউরোপীয়ের তুলনায় ঢের কম।

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৪ ০০:০৩

অর্থনীতির ছাত্ররা বলিবেন, কোনও পণ্যের জোগান বাড়িলে তাহার দাম কমে। ভারতীয় রাজনীতিকদের দেখিলে আশঙ্কা হয়, তাঁহারা বুঝি অর্থনীতির এই প্রাথমিক পাঠটিকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়া বসিয়াছেন। তাঁহারা বুঝি পণ্যের নিয়মকে মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ভাবিয়াছেন। সেই সমীকরণ বলিবে, ভারতে যেহেতু মানুষের সংখ্যা প্রচুর, অতএব এক জন সাধারণ ভারতবাসীর প্রাণের দাম এক জন সাধারণ ইউরোপীয়ের তুলনায় ঢের কম। যে খাদ্যদ্রব্য ইউরোপীয়রা মুখেও তুলিবেন না, তাঁহাদের সরকার মুখে তুলিতে দিবেন না, সেই খাদ্যই ভারতীয়রা খাইতে বাধ্য— এমন আশ্চর্য পরিস্থিতিকে আর কোন যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি ভারত হইতে বেশ কয়েকটি কৃষিজাত পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করিয়াছে। আলফনসো আম লইয়া শোরগোল হইয়াছে বেশি, কিন্তু নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় তাহার সহিত আছে করলা, বেগুন, গাঠি কচু এবং চিচিঙ্গা। কারণ একটিই: ভারত হইতে রফতানিকৃত এই কৃষিপণ্যগুলিতে মৃত পোকামাকড় পাওয়া গিয়াছে, যাহা ইউরোপীয় মাপকাঠিতে অগ্রহণযোগ্য। ভারতের কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রক এই একতরফা সিদ্ধান্তে আপত্তি জানাইয়াছে। এই বৎসর পয়লা এপ্রিল হইতে ভারত যে রফতানির ক্ষেত্রে উন্নততর মাপকাঠি গ্রহণ করিয়াছে, তাহাও বলিয়াছে।

বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের পেশিশক্তি কতখানি, এই নিষেধাজ্ঞার প্রশ্নে আরও এক বার তাহার পরীক্ষা হইবে। ভারত যে নূতন মাপকাঠি তৈরি করিয়াছে, তাহা সত্যই আন্তর্জাতিক মানের কি না, তাহারও বিচার হইবে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর প্রশ্নটির গায়ে আঁচড়ও লাগিবে না। ভারতের একশত ত্রিশ কোটি মানুষ প্রতি দিন যে খাবার খাইতে বাধ্য হন, তাহার কী হইবে? রফতানির মাপকাঠি তো আর দেশের বাজারের জন্য প্রযোজ্য হইবে না। ফলে এই একশত ত্রিশ কোটির পাতে মৃত পোকামাকড়ও পড়িবে, কীটনাশকের বিষও মিশিবে। কর্তারা সম্ভবত ভাবেন, এত মানুষের মধ্যে কয়েক জন যদি এই বিষে মারাও যান, ক্ষতি কী! বাকিরা নীলকণ্ঠ। কৃষিক্ষেত্র হইতে উঠিয়া আসা বিষই তাঁহাদের নিয়তি। ফলে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান যে খাদ্যদ্রব্য প্রত্যাখ্যান করিবে, ভারতীয়দের পাতে তাহাই পড়িতে থাকিবে। যাহাদের প্রাণের দাম নাই, সেই এলেবেলেদের লইয়া কাহার মাথাব্যথা?

এমন অবস্থা চলিতে পারে না। ভারতীয় বলিয়াই যাহা জুটিতেছে তাহাই খাইতে হইবে, এমন জুলুম মানিয়া লওয়া যায় না। কৃষিতে স্বাস্থ্যবিধি কঠোর হওয়া প্রয়োজন। সারের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে, কীটনাশকের ক্ষেত্রেও কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। কী ভাবে কৃষিপণ্য বাজারে পৌঁছাইতেছে, তাহাতে পোকামাকড় রহিয়া যাইতেছে কি না, কোন জল ব্যবহার করা হইতেছে, সব কিছুই দেখিতে হইবে। কাজটি যে খুব কঠিন, তাহা নহে। বস্তুত, ইউরোপীয় দেশগুলি বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে নিয়মগুলি মানে, তাহার বেশির ভাগই প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধির অন্তর্গত। ভারতেও সেই মান বজায় রাখিতে না পারিবার কোনও কারণ নাই। একমাত্র বাধা সদিচ্ছার। রাজনীতিকদের বুঝিতে হইবে, ভারতীয়দের জীবন অন্য কাহারও জীবনের তুলনায় সস্তা নহে। কেহ বলিতে পারেন, এই গোত্রের স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগ করিলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়িবে, তাহা মূল্যবৃদ্ধি ঘটাইবে। কথাটি অংশত ভুল, কারণ স্বাস্থ্যবিধির বেশির ভাগ প্রক্রিয়ারই ব্যয় যৎসামান্য। তাহার পরেও যে মূল্যবৃদ্ধি, তাহা মানিয়া লইতে হইবে। দীর্ঘমেয়াদে কম রোগভোগ, উন্নততর স্বাস্থ্যের কারণে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং চিকিৎসার ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে সেই মূল্যবৃদ্ধির ক্ষতিপূরণ হইবে। কোনও যুক্তিতেই স্বাস্থ্যবিধির প্রশ্নে আপস চলিতে পারে না।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy