Advertisement
০২ জুন ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু

‘শেক্সপিয়রের ছবি’ ও সেই সূত্রে

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৪ ০০:৩৯
Share: Save:

‘শেক্সপিয়রের ছবি’ ও সেই সূত্রে

শঙ্করলাল ভট্টাচাযের্র্র ‘অপরাজিত’ (২৬-৪) লেখাটি পড়তে গিয়ে সাত কলম জুড়ে থাকা ছবিটা দেখে চমকে উঠলাম। কারুকার্যময় লেসের Ruff (ষোড়শ শতকে ব্যবহৃত কুঁচি দেওয়া চওড়া গলবেষ্টনী) পরা কিছুটা লম্বাটে মুখের ইউরোপীয় এই যুবকপ্রতিম প্রতিকৃতি কি সত্যিই শেক্সপিয়রের? শেক্সপিয়রের যে সব প্রতিকৃতি আমরা সচরাচর দেখতে পাই ২০০৪ সালে প্রকাশিত স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাট-এর ‘উইল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড: হাই শেক্সপিয়র বিকেম শেক্সপিয়র’ বইতে ছাপা শেক্সপিয়রের দুটি প্রতিকৃতির অনুলিপি। প্রথমটি ১৬২৩ সালে প্রকাশিত ‘মি. উইলিয়ম শেক্সপিয়রস কমেডিস, হিস্টরিস অ্যান্ড ট্র্যাজেডিস’ বইয়ের ফার্স্ট ফোলিয়োর টাইট্ল পেজে খোদাই করা শেক্সপিয়রের প্রতিকৃতির ছবি। এই ছবির শিল্পী মার্টিন ড্রুসাউট (আনুমানিক ১৬০১-১৬৫০)। শেক্সপিয়রের মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স মাত্র পনেরো বছর হওয়ার দরুন সম্ভবত তাঁকে চাক্ষুষ দেখতে পাননি। কিন্তু বইটির সম্পাদকরা নিশ্চয়ই শেক্সপিয়রকে ভালই চিনতেন এবং মার্টিনের আঁকা শেক্সপিয়রের এই প্রতিকৃতির খুঁটিনাটি তাঁদের সন্তুষ্ট করেছিল বলে অনুমান করা যায়। দ্বিতীয় প্রতিকৃতিটিও শেক্সপিয়রের বলে অনেক পণ্ডিত মনে করেন। এই ছবিতে পোশাকের সারল্যের সঙ্গে সোনার কর্ণাভরণ কিছুটা পার্থক্য রচনা করেছে। ছবিটির মালিক উইলিয়াম ড্যাভেন্যান্ট নিজেকে শেক্সপিয়রের ধর্মপুত্র বলে দাবি করতেন এবং নিজেকে তাঁর বিধিবহির্ভূত সন্তান বলে নানা ভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই দুটি প্রতিকৃতির সাধারণ পোশাকের সঙ্গে আপনাদের পত্রিকায় প্রকাশিত শেক্সপিয়রের ছবিটিকে ঠিক মেলানো যায় না।

শঙ্করলালবাবু লিখেছেন, ‘...জ্ঞানসীমার ঊর্ধ্বে ওঠার সিঁড়িটা যে কী, পৃথিবী সেই থেকে ভেবেই চলেছে... এই এত সব আসে কোত্থেকে, কী পড়াশোনা, কোন সংসর্গে, এর কী নিষ্পত্তি আমরা পাচ্ছি!’ বাস্তবিকই, শেক্সপিয়রের শিক্ষার ব্যাপারে অনেকটাই পরোক্ষ অনুমানের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। উইলিয়মের দস্তানা প্রস্তুতকারী মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পিতার বাড়ি থেকে স্ট্র্যাটফোর্ডের গ্রামার স্কুলের দূরত্ব ছিল তিনশো গজের মতো। ১৫৭১ থেকে ১৫৭৫ সাল পর্যন্ত সেই স্কুলের মাস্টার ছিলেন অক্সফোর্ডের স্নাতক সাইমন হান্ট। সাত থেকে এগারো বছর বয়স পর্যন্ত উইলিয়ম হয়তো তাঁর ছাত্র ছিলেন। সাইমন এক জন ক্যাথলিক হওয়ার দরুন তাঁর ধর্মীয় অভিজ্ঞতা উইলিয়মের যৌবনে প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু এমন কোনও প্রমাণ নেই যাতে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় স্ট্র্যাটফোর্ড গ্রামার স্কুলে উইলিয়ম পড়েছিলেন। তবে এ কথাও বলা যায়, বাড়ির এত কাছে স্কুল ছাড়া কোথায়ই বা ওই কিশোর তাঁর প্রথম জীবনের জ্ঞান আহরণ করবেন? ১৫৭৯-’৮০ সালের কোনও এক সময়ে স্কুল ছাড়ার বয়সে তিনি যখন পনেরো কি ষোলো তখন কি তুলনীয় দ্বৈত সচেতনতা তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল? শেক্সপিয়রের বিভিন্ন নাটকে দ্বৈতীয়ীকতার যথেষ্ট প্রমাণ দেখা যায় হ্যামলেট একই মুহূর্তে ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট ও দুয়েই গভীর অবিশ্বাসী। কিন্তু পূর্ণবয়স্ক শেক্সপিয়র ধর্মীয় সংগ্রামে গভীর ভাবে মথিত হলেও কিশোর শেক্সপিয়র আসলে কী বিশ্বাস করতেন তা আমাদের অজানা। গল্পগুজব, ইঙ্গিত, আবছা সূত্র ইত্যাদির সমাহার থেকে একটি ছায়াময় ছবির ক্ষীণ আভাস পাওয়া যেতে পারে। পুরনো দেওয়ালের উপর দাগ দেখে যেমন কোনও অবয়বের সামান্য ধারণা করা সম্ভব। অক্সফোর্ড বা কেম্ব্রিজে না-পড়লেও শেক্সপিয়রের পড়াশোনা যে কম ছিল না তার প্রমাণ পাওয়া যায় অল্পবয়সে লেখা তাঁর ‘দ্য কমেডি অব এররস’ নাটকটিতে। লাতিন কমেডির আহরিত জ্ঞান কেমন সহজ সৌকর্যে সেখানে প্রতিভাত হয়েছে! স্ট্র্যাটফোর্ড স্কুলের রেকর্ড নষ্ট হয়ে গেলেও উইলিয়ম যে বাবা-মার ইচ্ছাপূরণের জন্য সেখানে লাতিনের শিক্ষা নেন তা অনুমান করা যেতেই পারে। সেখানে পাঠ্য বই মুখস্থ করা, পুনরাবৃত্তি, পাঠ্যবস্তু বিশ্লেষণ ইত্যাদি প্রচণ্ড শাসনের মধ্যে শেখানো হত। প্রত্যেকে বুঝতে পারত, লাতিন শিক্ষা ও বেত্রাঘাতের মধ্যে কোনও পার্থক্য ছিল না। তৎকালীন এক জন শিক্ষাবিদের অনুমান ছিল, লাতিন শিক্ষা সহজসাধ্য করার জন্য নিতম্বের সৃষ্টি হয়েছে। এক জন আধুনিক পণ্ডিত বলেছেন, সে সময় লাতিন শেখা কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়ার ধর্মীয় আচার-আচরণ অনুসরণ করার মতোই যন্ত্রণাময় ছিল।

উইলের স্কুলে থাকার অনুমিত সময়ে স্ট্র্যাটফোর্ডের শিক্ষকরা ছাত্রদের দিয়ে বছরে কোন কোন নাটক মঞ্চস্থ করাতেন তার কোনও নথিবদ্ধ তথ্য না-থাকলেও সম্ভবত উইলের বিদ্যালয় ছাড়ার কয়েক বছর আগে অক্সফোর্ড থেকে পাশ করা শিক্ষক টমাস জেনকিন্স প্লাতাউস প্রণীত একই রকম যমজ নিয়ে উন্মত্ত হাসির প্রহসন Two Menaechmuses ছেলেদের দিয়ে অভিনয় করানোর সিদ্ধান্ত নেন। হয়তো সেই উপলক্ষে ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় লেখক ও অভিনেতাকে তিনি বেছে নেন আর সেই ছাত্রটিই হয়তো উইলিয়ম শেক্সপিয়র, যাকে মূল চরিত্র রূপায়ণের জন্য নির্বাচিত করা হয়। শেক্সপিয়রের পরবর্তী জীবনের নানা বিষয় থেকে অনুমান করা যায়, তিনি এই বিশেষ নাটকের যুক্তি ও মাথা ঝিমঝিম করা বিভ্রান্তি, প্রত্যয় সাক্ষাৎ থেকে চরিত্রদের বার বার অল্পের জন্য সরে যাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা ও গোলমাল মেটানোর ব্যাখ্যার যৌথ ব্যাপারটা খুবই উপভোগ করতেন। লন্ডনে তরুণ নাট্যকার হিসেবে কমেডির কাহিনি অনুসন্ধান করার সময় তিনি Two Menaechmuses নাটকটি বেছে নেন। গোলমালের বহর আরও বাড়ানোর উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় যমজের আমদানি করে লিখে ফেলেন ‘দ্য কমেডি অব এররস’। নাটকটির সাফল্যে লন্ডনে যে হইচই পড়ে যায় তা আদৌ সম্ভব হত কি না সন্দেহ, যদি না কিংস নিউ স্কুলের প্রতিভাবান ছাত্রটি প্লাতাউসের নাটকটি ঠিক মতো আত্মস্থ করতে পারতেন।

শঙ্করলালবাবু লিখেছেন, ‘খুব সম্ভব যে শেক্সপিয়রের জন্ম ২১, ২২ বা ২৩ এপ্রিলের কোনও একটি ছিল। তবে ২৩-এ ফেললে জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে পড়ে বেশ নাট্য সঞ্চার হয়’। পণ্ডিতেরা ২৩ এপ্রিলকেই তাঁর জন্মদিন স্থির করেছেন এই গণনায় যে, সে সময়ে জন্মদিন ও ব্যাপটিজম (খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা)-এর মধ্যে তিন দিনের ব্যবধান থাকত। আমাদের ২৫ বৈশাখের মতো ২৩ এপ্রিলও ব্রিটেনে সমাদৃত। শেক্সপিয়রের সমাধি যে ১৬১৬ সালের ২৫ এপ্রিল হয়, তা স্ট্র্যাটফোর্ডে নথিবদ্ধ হলেও তাঁর শেষ মূহূর্তগুলো সম্পর্কে সমসাময়িক বিবরণ পাওয়া যায় না। তাই ২৩ এপ্রিলেই তাঁর মৃত্যু, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।

মনোজ ঘোষ। কলকাতা-৬১

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE