সূর্যকান্ত মিশ্রদের বেদনা এক শ্রীরাধিকাই বুঝিবেন। শ্যামের বাঁশিতে ঘর ছাড়িবার সুর বাজিয়া উঠিলে পতিগৃহের খিল তোলা দরজা যেমন হৃদয়বিদারক, কংগ্রেসের হাত ধরিতে ব্যাকুল রাজ্য সিপিআইএম নেতৃত্বের নিকট পলিটব্যুরোর রক্তচক্ষুও তেমনই। দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, অধীর চৌধুরীরা আকবর রোড ও জনপথে জোটের পক্ষে জোর সওয়াল করিয়া আসিয়াছেন, অথচ পলিটব্যুরো ঘাড় না নাড়িলে শেষ অবধি রাজ্য নেতারা নাচার। জয়ের মুখ হইতে হার ছিনাইয়া লওয়ার দক্ষতা প্রকাশ কারাটদের বিলক্ষণ আছে। ফলে, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে শেষ অবধি একা লড়িয়া গুটিকয় আসনের ‘লাল দুর্গ’ লইয়াই সূর্যকান্ত মিশ্রদের সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে, সেই সম্ভাবনা উড়াইয়া দেওয়া মুশকিল। খেলা যদি ঘুরাইতেই হয়, তবে এ কে গোপালন ভবনের ভরসায় বসিয়া থাকিলে চলিবে না। কারাটদের নিকট পশ্চিমবঙ্গ সামগ্রিক ছবির একটি অংশমাত্র। বস্তুত, নিখাদ রাজনৈতিক হিসাবে সিপিআইএম-এর মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের যতখানি গুরুত্ব প্রাপ্য, কারাট এবং তাঁহার কেরল লবির চক্ষে রাজ্য তাহার তুলনায় কম গুরুত্ব পায়। তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ লড়াইয়ের তুলনায় তাঁহাদের নিকট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত পরমাণু চুক্তিতে কংগ্রেসের সহিত মতবিরোধ অধিকতর গুরুত্ব পাইতেই পারে। রাজ্যেই যদি নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইতে হয়, তবে আর জাতীয় রাজনীতি লইয়া বঙ্গনেতারা কী করিবেন? কাজেই, সূর্যকান্তবাবুদের প্রয়োজনে একলা চলিতে হইবে। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি বহু বার ভাঙিয়াছে। কেরল ও বঙ্গের দ্বন্দ্বে আরও এক বার ভাঙিলে দাস কাপিটাল অশুদ্ধ হইবে না।
দ্বন্দ্বটি সেই সুপ্রাচীন সদর বনাম মফস্সলের। যাঁহারা কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত, তাঁহাদের সহিত প্রান্তের স্বার্থ সমানুবর্তী হইবে, এমন আশা করাই ভুল। কেন্দ্র চাহিবে, নিজের স্বার্থ ভুলিয়া প্রান্তও সর্বভারতীয় ছবিটিকে আপন করিয়া লউক। বিধানচন্দ্র রায় যখন রেলের শুল্ক সমীকরণে সম্মতি জানাইয়াছিলেন, তখন তিনি অন্তত আংশিক ভাবে সজ্ঞানেই রাজ্যের স্বার্থ বিসর্জন দিয়াছিলেন। সিপিআইএম-এর ছবিটি বিচিত্রতর। সেখানে কেন্দ্র কথাটি আলঙ্কারিক, কারণ কেরল ও বঙ্গ (ও ত্রিপুরা), এই দুইটি প্রান্তই দলটির সর্বস্ব। তবুও, প্রকাশ কারাটরা কেন্দ্রের সিংহচর্মটি খুলিতে পারেন নাই। পশ্চিমবঙ্গের নেতারা কংগ্রেসের সহিত জোট চাহিলে তাঁহাদের নিকট কেরলের স্বার্থ গুরুতর হইয়া উঠে। তত্ত্বের ঝুলিতে যথেষ্ট আপত্তি খুঁজিয়া না পাইলে তাঁহারা ইতিহাসের পাতা উল্টাইয়া ওজর খোঁজেন। অনুমান করা চলে, সবের মূলে আছে নিয়ন্ত্রণের রাশ না ছাড়িবার খেলা। রাজ্যের স্বার্থ কেন্দ্রকে ছাপাইয়া গেলে কেন্দ্রিকতার মারাত্মক ক্ষতি।
সমস্যা জটিলতর হয়, যদি কেন্দ্র বনাম রাজ্যের এই দ্বন্দ্বে মাঠে-ময়দানে রাজনীতি করা এবং না করার ফারাকও থাকে। পলিটব্যুরো গজদন্তমিনারবিশেষ, সেখানে মাটির আওয়াজ পৌঁছায় না। তাঁহারা বুঝিতে পারেন না, বঙ্গের সিপিআইএম স্থানীয় দলমাত্র। তাহার না আছে বিজেপির ন্যায় হিন্দুত্ববাদী আবেগ, না আছে কংগ্রেসের ন্যায় কিছুই না হারানোর ভয়হীনতা। পশ্চিমবঙ্গে লড়িতে হইলে সিপিআইএম-এর স্থানীয় অস্ত্র প্রয়োজন। তাহার নিকট মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা অপেক্ষা রাজারহাটের সিন্ডিকেট অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন। রাজ্যে অস্তিত্ব টিকাইয়া রাখিতে হইলে সিপিআইএম-কে স্থানীয় দল হিসাবেই লড়িতে হইবে, স্থানীয় সমীকরণ মানিয়া জোট বাঁধিতে হইবে। শুধুমাত্র রাজ্যের কথা বিবেচনার যে সুবিধা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আছে, তাঁহার সহিত টক্কর দিতে হইলে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটকেও তাহার অধিকারী হইতে হইবে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ঘুচাইতে যদি হাঁড়ি পৃথক করিতে হয়, তবে তাহাই পথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy