হকারদের উৎপাত আবার সংবাদের শিরোনামে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কলিকাতার নিউ মার্কেট চত্বরে দুই মহিলা পথচারীকে হকারদের নিগ্রহই এ বারের উপলক্ষ। তাঁহাদের অপরাধ, রাস্তা জুড়িয়া ছড়াইয়া রাখা বিকিকিনির পসরায় নাকি তাঁহাদের পা লাগিয়া গিয়াছিল। তাহাতে মহাভারত এমনই অশুদ্ধ হইয়া যায় যে, এক হকার সজোরে মহিলার গালে চড় কষাইয়া দেন। যেন পথ পথচারীদের চলিবার জন্য নয়, হকারদের পসরা সাজাইয়া বসার জন্যই তৈয়ার হইয়াছে। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া নিউ মার্কেট এলাকায় জবরদখলকারী অবৈধ হকারদের সহিত বৈধ দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের বিরোধ বাধিয়া ওঠে। উভয় পক্ষকে শান্ত করিতে প্রথমে পুলিশ, পরে খোদ পরিবহণ মন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করিতে হয়। ঘটনাটি নিউ মার্কেট চত্বরের হইলেও রাস্তা ও ফুটপাথ জবরদখল করিয়া পথচারীদের যাতায়াতে বিঘ্ন সৃষ্টির ঘটনা কলিকাতার সর্বত্রই।
কলিকাতা এক বিস্তৃত হকারনগরী। এই জবরদখলকারীদের দৌরাত্ম্যে বৈধ লাইসেন্সধারী অনেক দোকানের প্রবেশপথ পর্যন্ত ক্রেতারা খুঁজিয়া পান না। ফুটপাথ তো কবেই হকারদের দখলে চলিয়া গিয়াছে, এখন যান-চলাচলের রাস্তার সিকিভাগ, কখনও অর্ধেক জুড়িয়াও তাঁহাদেরই প্রতিপত্তি। তাঁহাদের ছড়ানো-ছিটানো মালপত্রের পসরা বাঁচাইয়া নাগরিকদের অতি সন্তর্পণে এবং প্রভূত শারীরিক কসরত করিয়া বাঁকিয়া-চুরিয়া নিজেদের গন্তব্যে যাওয়ার পথ করিয়া লইতে হয়। মালপত্রে কাহারও পা ঠেকিয়া গেলেই তুলকালাম। বৃহস্পতিবারের ঘটনাটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, নিয়মিতই এমন অনাচার হকারসেবিত এই শহরের পথে-ঘাটে ঘটিতেছে। পরিবহণ মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বৈধ, লাইসেন্সধারী দোকানদারদের সহিত জবরদখলকারী হকারদের দ্বন্দ্বে আপাতত বিরতি হইয়া থাকিতে পারে। কিন্তু তাহাতে পথচারীদের স্বস্তির কোনও হেতু নাই। তাঁহাদের অসুবিধা, অসম্মান, নিগ্রহ ও লাঞ্ছনার কথা কেহই গুরুত্ব দিয়া ভাবেন না। কেননা ভোটার হিসাবে তাঁহারা সংগঠিত নহেন। খামখা নাগরিকদের অসুবিধা লইয়া রাজনীতিকরা কিংবা সরকার ভাবিত হইবেন কেন?
তাই যাঁহারা পুরসভার জল, সিইএসসি-র বিদ্যুৎ, সরকার নির্মিত প্রকাশ্য জনস্থান বিনা ভাড়ায় যথেচ্ছ ব্যবহার করেন, তাঁহাদের বাবা-বাছা করিয়া তোষণ করা এখন দলীয় রাজনীতিক ও নেতা-মন্ত্রীদের দস্তুর। এই রাজনৈতিক প্রশ্রয় এমন জায়গায় পৌঁছাইয়াছে যে, নূতন কোনও উপনগরী নির্মিত হইতে না হইতে তাহার কেন্দ্রস্থলটি হকারদের জবরদখলে চলিয়া যায়। প্রধানত শাসক দলের পৃষ্ঠপোষকতাই এই প্রক্রিয়ার প্রেরণা হিসাবে কাজ করে। রাজারহাট-নিউটাউনের মতো নির্মীয়মাণ উপনগরীও এই জবরদখলে গ্রস্ত হইতেছে। এখনও ভাল করিয়া নগরীর বিস্তার হয় নাই, অনেক কাজই অনারব্ধ, আরব্ধ প্রকল্পগুলিও অধিকাংশই মধ্যপথে। কিন্তু হকাররা নিজ-নিজ এলাকা বাছিয়া লইয়া পসরা লইয়া বসিয়া পড়িতেছেন। ভবিষ্যতে কখনও যদি উপনগরীর বিস্তারের স্বার্থে জবরদখল উচ্ছেদ করিতে হয়, তখন আবার এই হকারদের পুনর্বাসনের দাবি উঠিবে, এই স্বনিয়োজিত বেকার যুবকেরা কোথায় যাইবে, তাহার বিকল্প বন্দোবস্ত করার ‘মানবিক’ দাবি আদায়ের আন্দোলন সংগঠিত হইবে। শেষ পর্যন্ত পুনর্বাসন প্রকল্প পরিত্যক্ত হইবে, হকাররাও জবরদখলে অটল থাকিয়া যাইবেন। হকারনগরী ছিল, আছে, থাকিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy