Advertisement
E-Paper

সংসার সুখের হয় ফার্স্ট লেডিদের গুণে

মিশেল ওবামা-কে পরের বার খাওয়াতে চান নিজের হাতে রাঁধা শুক্তো। তিনি শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। রাইসিনা হিলে কেমন জমল দুই প্রথমার সাক্ষাৎ? লিখছেন সঙ্গীতা ঘোষমিশেল ওবামা-কে পরের বার খাওয়াতে চান নিজের হাতে রাঁধা শুক্তো। তিনি শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। রাইসিনা হিলে কেমন জমল দুই প্রথমার সাক্ষাৎ?

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০৮

‘টু শ্রীমতী শুভ্রা মুখার্জি

ফ্রম আওয়ার গার্ডেন টু ইয়োর্স’

মিশেল ওবামা

নিজের লেখা বই ভারতের ফার্স্ট লেডি শুভ্রা মুখোপাধ্যায়কে উপহার দিলেন আমেরিকার ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা। পুস্তানিতে লিখে দিলেন শব্দবন্ধ, ‘ফ্রম আওয়ার গার্ডেন টু ইয়োর্স’ ... আমাদের বাগান থেকে তোমাদের বাগানে।

নিজের দেশ আমেরিকা থেকে ভারতে, শুভ্রার দেশেই তো এসেছিলেন মিশেল। স্বামী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে। আর সেই উপলক্ষেই রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ। কথা ও উপহার বিনিময়। বইয়ের সঙ্গে মিশেল দিলেন ঝকমকে পাথর বসানো একটি গলার হারও। শুভ্রা মিশেলকে দিলেন একটি তুঁতে-আইভরি কাশ্মীরি পশমিনা শাল।

২৬ জানুয়ারি। রাষ্ট্রপতি ভবন। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় মুঘল গার্ডেন্সের সুবিশাল ঘাসে-ছাওয়া চত্বরে দেখা হল শুভ্রা-মিশেলের। ‘অ্যাট হোম’-এ। (প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রপতি ভবনের চত্বরে নির্বাচিত অতিথিদের জন্য আয়োজন করা হয় চায়ের আসর ‘অ্যাট হোম’)।

“কেমন আছেন শুভ্রা?” জানতে চাইছিলেন মিশেল। ঠিক সেই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় শুভ্রার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও মিশেলের। “মিট মাই ওয়াইফ” বললেন রাষ্ট্রপতি। “নমস্তে”। হাসিমুখে শুভ্রাকে অভিনন্দন জানালেন বারাক ওবামা ও মিশেল। জানালেন ভারতে এসে আনন্দিত তাঁরা। শুভ্রাও জানালেন উষ্ণ অভ্যর্থনা। ধন্যবাদও দিলেন পরস্পর পরস্পরকে। মুহূর্তের মধ্যে সৃষ্টি হল আন্তরিকতার বাতাবরণ। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত ও সর্বাধিক শক্তিধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রথমার মধ্যে যেন ঘটল হৃদয়ের মেলবন্ধন।

শুভ্রার দেওয়া কাশ্মীরি পশমিনা শাল উপহার পেয়ে উচ্ছ্বসিত মিশেল। “থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ,” প্রতিক্রিয়া বিহ্বল মিশেলের।

দারুণ খুশি শুভ্রাও। “মিশেল আমাকে তাঁর লেখা যে বইটি উপহার দিলেন, ‘আমেরিকান গ্রোন: দ্য স্টোরি অব হোয়াইট হাউস কিচেন গার্ডেন অ্যান্ড গার্ডেন্স অ্যাক্রস আমেরিকা’য় হরেক রকমের রান্নার রেসিপি আছে। হোয়াইট হাউস কিচেন গার্ডেনের খুঁটিনাটি বিবরণের পাশাপাশি রয়েছে হোয়াইট হাউসে বাগান করার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কাহিনি। এবং অবশ্যই খাদ্যতালিকা কী করে স্বাস্থ্যকর করা যায়, যা ওবেসিটি দূর করতে পারে, তার বিবরণ।” ইতিমধ্যেই বইটি প্রায় পড়ে ফেলেছেন ভারতের প্রথমা শুভ্রা!

শুভ্রাও বেশ কয়েকটি বইয়ের রচয়িতা। তার মধ্যে ইন্দিরা গাঁধীকে নিয়ে লেখা ‘চোখের আলোয়’ ইংরেজি-সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

তা নিজের লেখা বই দিলেন না মিশেলকে?

‘‘... সে কবেকার কথা,” বিনয়ের সঙ্গে প্রসঙ্গটা উড়িয়ে দিতে চাইলেন শুভ্রা। “পরে কখনও দেব...।”

তা মার্কিন ফার্স্ট লেডি যে-সব রান্নার পদের কথা লিখেছেন সেই সব রান্না করবেন না কি?

“দেখা যাক,” বললেন শুভ্রা।

হারটা কি সোনার?

“না। তবে উপহার সব সময়ই আমার কাছে দারুণ মূল্যবান। আর এ তো সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পার থেকে আনা।”

“মিশেলকে খেতে নিমন্ত্রণ করলাম। তবে উনি তো এর মধ্যেই ফিরে গেলেন ওঁর দেশে,” শুভ্রার কণ্ঠে যেন বিষাদের ছোঁয়া। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় প্রবাসে ফিরে গেলে যেমনটি হয়।

যদি মিশেল ফের এ দেশে আসেন, আপনার আতিথেয়তা গ্রহণ করেন, রেঁধে খাওয়াবেন তাঁকে? কী খাওয়াবেন?

মুহূর্তের উত্তর “শুক্তো।”

শুক্তো!

লাজুক হাসলেন শুভ্রা। “বিয়ের পরে শাশুড়ি-মায়ের কাছে ওই পদটাই প্রথম শিখেছিলাম। সকলে আমার রান্না শুক্তো খুব পছন্দ করতেন। উনিও,” অর্থাৎ স্বামী প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রথমার গালে যেন আবিরের ছোঁয়া।

দুই নারীর শ্যামল ত্বকের ঝলমলে ঔজ্জ্বল্য যেমন আকর্ষণীয়, তেমনই উভয়ের নাচ-গান-সঙ্গীত প্রীতি সমান ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০১০-এ ভারত সফরে এসে মুম্বইয়ে দুঃস্থ ও অনাথ শিশুদের সঙ্গে নেচেগেয়ে সাড়া ফেলে দেন মিশেল। তাঁর ৫০তম জন্মদিনে হোয়াইট হাউসের ইস্ট রুম ভেসে যায় নৃত্যগীতের মূর্ছনায়। গান করেন বেয়ন্স, নাচেন পল ম্যাককার্টনে।

শুভ্রা আশৈশব রবি-অনুরাগিণী। তাঁর ট্রুপ ‘গীতাঞ্জলি’ ভারত-সহ বিশ্বের নানা দেশে রবীন্দ্র নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান করে চলেছে এখনও।

শুভ্রা-মিশেল, দু’জনের সুর মিলে গেল অনায়াসে। এ যেন প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের মিলন।

শুভ্রা বয়োজ্যেষ্ঠা। ঠাকুমা হয়ে গিয়েছেন। মিশেলের কন্যা মালিয়া আর সাশা এখনও কিশোরী। স্রোতস্বিনী মিশেলের পাশে শুভ্রা যেন শান্ত দিঘি।

শুভ্রার পরনে ঘি ও সোনা রঙের মিশেলে অসমিয়া সিল্কের শাড়ি। পাড়ে লাল-সবুজ সুতোর ভরাট নকশা। শাড়ির জমিতে হাল্কা বুটি। প্রায় নতুন। আগে মাত্র এক বার পরেছেন। তুলসীর বিডস সোনা দিয়ে বাঁধানো হার ও একটি চেন তাঁর গলায়। হাতে বালা-চূড়। সঙ্গে শাঁখা-পলা। চুল টেনে বাঁধা।

অ্যাট হোম: স্বামীদের সঙ্গে ফার্স্ট লেডিরা। ছবি সৌজন্য: রাষ্ট্রপতি ভবন

কপালে ও সিঁথিতে সিঁদুর। এক্কেবারে ঘরোয়া সাজ। নেই কোনও ডিজাইনারের ছোঁয়া। “আগে থেকে কোনও পোশাক পরিকল্পনা করিনি। আমি বরাবরই যা করে থাকি, কোন শাড়িটা পরব, তা শেষ মুহূর্তে ঠিক করি,” অবলীলায় বলে যান ভারতের প্রথমা। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেশে-বিদেশে কত ঘুরেছেন তিনি। চিরদিনই সেই শাড়ি-শাঁখা-পলা-সিঁদুরেই তাঁর প্রসাধন। “আমার মা বলতেন ক’টা মেয়ের ভাগ্য হয় শাঁখা-পলা পরে থাকার,” সরল ভাবে বলে ফেললেন দেশের অন্যতমা ভিভিআইপি।

আর মিশেল?

মহিলাদের কাছে তিনি অনুপ্রেরণা। পঞ্চাশে পৌঁছেও কেমন করে আভিজাত্য-লাবণ্য-উষ্ণতায় পরিপূর্ণ হয়ে নবীন যৌবনা হয়ে ওঠা যায়, মিশেল তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁকে অনায়াসেই বলা চলে ‘ফ্যাশন আইকন’। তাঁর ওয়ার্ড্রোবে রয়েছে ইসাবেল টোলেডো, জেসন উ, তাকুন, মারিয়া পিন্টো... দুর্দান্ত সব ফ্যাশন ডিজাইনারদের সৃষ্টি। নয়াদিল্লিতে মার্কিন সেনাবিমান এয়ারফোর্স ওয়ান থেকে মিশেল যখন স্বামীর হাত ধরে নামছেন তখন তাঁর পরনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ডিজাইনার বিভু মহাপাত্রের ‘স্প্রিং কালেকশন’-এর সিল্কের অভিনব পোশাক।

‘অ্যাট হোম’-এ তাঁর পরনে ছিল বেজ রঙের ফুলেল নকশাদার পোশাক।

ভারত সফরে এসে মিশেল যে সব পোশাক পরেছেন, রাষ্ট্রপতি ভবনের নৈশভোজ বা রাষ্ট্রপতি ভবনের ‘অ্যাট হোম’ অনুষ্ঠানে, তাতে ছিল ফুলেল ছোঁয়া। পোশাকের রং নাবিক নীল থেকে বেজ, গভীর থেকে হাল্কা। “রঙের পছন্দ যেন মিশেলের দৃঢ়চেতা মনের অভিব্যক্তিরই প্রতিফলন। মার্কিন ফার্স্ট লেডির ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রং নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে।” বক্তব্য ডিজাইনার নীলের। “উজ্জ্বল, গাঢ় থেকে হালকা, প্যাস্টেল শেড অনায়াসে ক্যারি করেন মিশেল। ঠিক যেমন তিনি অনায়াসে দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন মা, স্ত্রী, ফার্স্ট লেডি, লেখিকা, নৃত্যপটিয়সী, সমাজসেবিকার ভূমিকা। মিশেলের পোশাকে ফুলেল নক্শা নরম নারীত্বের প্রতীক। পোশাকে বোল্ড ডিজাইন যেন শক্তসমর্থ সমকালীন লড়াকু নারীর অভিজ্ঞান।” প্রত্যয়ের সুরে বললেন নীল।

পাশাপাশি দুই রাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি। পোশাক-পছন্দ-আদব কায়দা কোনওটাই অন্তরায় হল না দু’জনের মানসিক মেলবন্ধনে।

ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে মিশেলের দিকে তাকালেন শুভ্রা। সেই দৃষ্টিতে কোথায় যেন বিধুরতা, স্মৃতি বিহ্বলতা মিশে ছিল। কত বার তিনি ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গে হাই টি, নৈশভোজে গিয়েছেন! অসুস্থতার কারণে ওবামার
সম্মানে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আয়োজিত নৈশভোজে তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবসের হিমেল হাওয়া মাখা পড়ন্ত বিকেলে ভবনের উদ্যানে ‘অ্যাট হোম’-এ তিনি থাকলেন বেশ কিছুক্ষণ। বিকেল ৪টে বাজতে দশ মিনিট বাকি থাকতেই পৌঁছে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতির অতিরিক্ত ব্যক্তিগত
সচিব ও মুখোপাধ্যায় পরিবারের দীর্ঘদিনের সহকারী মৃণালকান্তি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে।

‘অ্যাট হোম’-এর ভোজসভায় ছিল দুর্দান্ত মেনু। ‘চিকেন মালাই টিক্কা’, ‘চিজ-শশা স্যান্ডউইচ’, ‘আলু মটর কা সমোসা’, ‘পনির র‌্যাপ’, ‘আনার ভোগ’ ও ফলের সমাহার। “কিছু খেলাম না..., শুধু চা খেলাম।’’ অকপটে জানালেন ভারতের ফার্স্ট লেডি। মিশেল নাকি ‘সমোসা’ খুব পছন্দ করেছেন।

মিশেল যদি কোনও দিন ভারতে আসেন তাজমহল দেখতে বা অন্য কোনও কারণে, নিশ্চিত ভাবে তিনি জেনে রাখুন তাঁকে আদর করে ডেকে নেবেন এক ঐতিহ্যময়ী ভারতীয় নারী। যিনি নিজের হাতে রেঁধেবেড়ে আসন পেতে বসিয়ে খাওয়াবেন।

এবং অবশ্যই শুক্তো।

ananda plus anandabazar obama sangeeta ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy